ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় চার দিনের যুদ্ধবিরতির চুক্তির আওতায় গত শুক্রবার ইসরাইলের কারাগারে বন্দি ৩৯ ফিলিস্তিনি নারী ও শিশু নিজ ভূমিতে ফিরেছেন। এই খুশি উদযাপন করতে ওইদিন আতশবাজি ফুটিয়ে তাদের বরণ করেন ফিলিস্তিনিরা। প্রায় দুই মাস ধরে চলমান সহিংসতায় এই প্রথমবার গোলাবারুদের পরিবর্তে আতশবাজির আলোতে আলোকিত হলো ফিলিস্তিনের রাতের আকাশ।
দীর্ঘ কারাবাসে থাকা স্বজনদের বরণ করতে শুক্রবার বাঁধভাঙা আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠেন পশ্চিম তীরের বাসিন্দারা। এ সময় ফিলিস্তিনি এবং হামাসের পতাকা হাতে বন্দি স্বজনদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন তারা। সাঁজোয়া যানের বহরের সঙ্গে কাফিয়েহ স্কার্ফসহ দুটি সাদা কোচ বন্দিদের নিয়ে ওফার সামরিক ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে এলে, উল্লাসে মেতে ওঠে উৎসুক জনতা। তবে এই আনন্দের মাঝেও তাদের হৃদয়ের যে ক্ষতের দাগ তা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে যাননি তারা। স্বজনদের দেখতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ অশ্রু আনন্দের, এ অশ্রু স্বজনদের হারানোর বেদনার।
মুক্তি পাওয়া বন্দিদের একজন ২৪ বছর বয়সি মারাহ বাকির। গাজা উপত্যকাজুড়ে প্রায় ১৫ হাজার নিহত বেসামরিকদের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, ‘মুক্তি পেয়ে আমি খুশি। তবে আমার এ মুক্তি শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে।’ গত আট বছরের বেশি সময় ইসরাইলের কারাগারে বন্দি থাকা বাকির বলেন, ‘কারাগারের চার দেয়াল’ থেকে মুক্তি পাওয়াটা সত্যিই চমৎকার।’
পূর্ব জেরুজালেমের বেইত হানিনায় তার পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার পর বাকির জানান, ‘কারাগারে আমি আমার শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছি, আমার বাবা-মা এবং তাদের স্নেহ থেকে অনেক দূরে ছিলাম। একটি নিপীড়ক রাষ্ট্রের কাছে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না।’ গাজায় যুদ্ধবিরতির চুক্তির আওতায় ইসরাইলের ১৩ জিম্মিকে হস্তান্তর করা হলে এর বিনিময়ে মোট ৩৯ জন ফিলিস্তিনি কারাবন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ।
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের মতে, গত ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরাইলে হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এক হাজার ২০০ ইসিরাইলি নিহত হয়, যা ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মৃত্যুর সংখ্যা।
ফিলিস্তিনি পক্ষের কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে ইসরাইলি হামলায় গাজায় যে পরিমাণ বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে, তা ফিলিস্তিনের ইতিহাসে বিগত দুটি ইন্তিফাদার সময় হওয়া হতাতের একত্রিত সংখ্যার চেয়েও অনেক বেশি।
ইসরাই হেফাজতে দুই মাস থাকার পর মুক্তি পেয়েছেন ৫৮ বছর বয়সি হানান আল-বারঘৌতি। তিনি হামাসের সশস্ত্র শাখার নেতা এবং গাজার জনগণের প্রশংসা করে বলেন, ‘আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দিন। গাজার জনগণ না থাকলে আমরা স্বাধীনতার মুখ দেখতে পেতাম না।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা কারাগারের ভিতরে ছিলাম, নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলাম। তারা আমাদের কষ্ট দিয়ে আনন্দ পেত। তারা আমাদের তিরস্কার ও অপমান করেছে। তবে তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় আমাদের গর্ব এবং মর্যাদা আরো সমুন্নত হয়েছে।’ ধূসর রঙয়ের জাম্ফার পরা ফিলিস্তিনি কারাবন্দিদের অধিকৃত পশ্চিম তীরের বেইতুনিয়ায় জড়ো করা হয়েছিল। সেখানে তাদের দেখে আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন অপেক্ষারত অনেকে। জড়ো করা বন্দিদের মুক্তির আগে, ফিলিস্তিনি জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। এর সঙ্গে সঙ্গে সাদা মেঘের মতো ধোঁয়ার ভরে যায় কারাগারের আশপাশ। ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, তখন ইসরাইলি নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছেন।
জেরুজালেমে এক পুলিশ কর্মকর্তাকে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টার দায়ে ২০১৬ সালে স্কুলে যাওয়ার পথে গ্রেপ্তার হন ২৩ বছর বয়সি মালাক। তার মা ফাতিনা সালমান বলেন, ‘ইসরাইলি পুলিশ আমাদের বাড়িতে রয়েছে এবং আমাদের কাছে মানুষদের আসতে বাধা দিচ্ছে।’ ২০২৫ সাল পর্যন্ত মালাকের মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল না। তবে চুক্তির আওতায় অন্যান্য বন্দিদের সঙ্গে গত শুক্রবার তিনিও নিজ স্বজনদের কাছে ফিরে আসেন। সালমান বলেন, ‘আমার মেয়ের শরীর দুর্বল। গতকাল থেকে কিছুই খায়নি সে।’ ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইলের দখলে রয়েছে পশ্চিম তীর। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অনুসারে, গত ৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার জবাবে পাল্টা হামলা শুরুর পর থেকে সেখানে ইসরাইলি সেনা এবং বসতি স্থাপনকারীদের হাতে ২০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
অসলো চুক্তির আওতায় পশ্চিম তীরের কিছু এলাকায় কৌশলগত অভিযান বাতিল করা হলেও, ফিলিস্তিনি শহরগুলোতে আবারো অভিযান চালাচ্ছে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ইসরাইলি সেনারা। তবে অনেক ফিলিস্তিনিদের কাছে শুক্রবার ছিল একদম অন্যরকম, উৎসবের রাত। বাকির বলেছিলেন, ‘পরিবারকে কাছে পেয়ে আমি খুব আনন্দিত। তাদের সঙ্গে আবারো একটি নতুন জীবন শুরু করব আমি।’ তিনি বলেন, ‘তারাও যে কতটা খুশি তা দেখে আমি আবেগাপ্লুত।’ তিনি আরো বলেন, ‘হ্যাঁ, তারা কাঁদছে, তবে এ অশ্রু আনন্দের।’
বিরতির প্রথম দিন প্রায় ২০০ ত্রাণবাহী ট্রাক ঢুকেছে গাজায়
হামাস-ইসরাইল যুদ্ধবিরতির প্রথম দিন গাজা উপত্যকায় ১৯৬টি ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির ফিলিস্তিন শাখা (পিআরসিএস)। শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে পোস্ট করা এক বার্তায় পিআরসিএস জানিয়েছে, ‘শুক্রবার গাজায় মোট ১৯৬টি ত্রাণ ও সহায়তা পণ্যবাহী ট্রাক রিসিভ করেছে পিআরসিএস। এসব ট্রাকের ৮টিতে ওষুধ ও মেডিকেল পণ্য, চারটি ট্রাকে হাসপাতাল শয্যা এবং বাকিগুলোতে খাদ্য, পানি ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় গত দেড় মাসে এই প্রথম একদিনে এত বেশি সংখ্যক সহায়তা পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করল। সূত্র : ইন্টারনেট