শীত মৌসুম এলেই শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত থাকেন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলের বাসিন্দারা। উপজেলাজুড়ে শুঁটকি উৎপাদনে হিড়িক পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলাকাজুড়ে ছোট বড় ৯৫ থেকে ১০০টি মহাল রয়েছে। আর এসব মহালে ১ হাজারেরও অধিক লোক শুঁটকি উৎপাদনে কাজ করেন। আর এই বিষমুক্ত শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন যাচ্ছে দুবাই, ওমানসহ বিভিন্ন দেশে। এতে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন হয়। চলতি মৌসুমে উপকূলে ৩ হাজার টন শুঁটকি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। কাঁচা মাছের চেয়ে শুঁটকি অনেকটা মজাদার হওয়ায় দামও থাকে বেশি। নভেম্বর থেকে আগামী ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে শুঁটকি উৎপাদনের কাজ। বড়ঘোপ বাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী আবুল কাশেম, শুঁটকি মহাল মালিক শফিউল আলম, ধুরুং বাজারের শুঁটকি ব্যবসায়ী বদিউল আলম, শাহ আলম জানান, নতুন ছুরি শুঁটকি কেজি ৮০০-১০০০ টাকা, লইট্টা ৫০০-৭০০ টাকা, মাইট্টা (সুরমা) ১৫০০-১৮০০ টাকা, চাকা চিংড়ি ১২০০-১৫০০ টাকা, ছোট চিংড়ি ৩৫০-৪৫০ টাকা, ফাইস্যা ৪০০-৫০০ টাকা রইস্যা ৪০০-৬০০, হুন্দরা ৮০০-১২০০ টাকা, প্রতি কেজি বড় ইছা ৭৫০-৮৫০ টাকা, জলিঙ্গা ইছা ৭০০-৭৫০ টাকা, মিশালি শুঁটকি ১৫০- ২০০ টাকা ও শুঁটকির গুঁড়া ৫০-১০০ টাকা পর্যন্ত বেচা বিক্রি হচ্ছে। সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলার বড়ঘোপ সমুদ্রচর, সন্দীপপাড়া, তাবালের চর, বড়ঘোপ স্টিমারঘাট, উত্তর ধুরুং, কৈয়ারবিল, আলি ফকির ডেইল প্রভৃতি স্থানে বড় শুঁটকি মহাল ছাড়াও অনেক জেলে পরিবারে নিজ আঙিনাতেও লবণও বিষ ছাড়া শুঁটকি উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। ক্ষুদ্র পরিসর থেকে শুরু করে বৃহৎ পরিসরে মাচা তৈরি করে শুকানো হচ্ছে বঙ্গোপসাগর থেকে আহরিত নানা জাতের মাছ। এ কাজে নিয়োজিত রয়েছে সহস্রাধিক শ্রমিক। পুরুষের পাশাপাশি নারী শ্রমিকরাও শুঁটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। শ্রমিকরা শুকনো শুঁটকি বাতাস দিয়ে বিশেষ কায়দায় উড়িয়ে পরিষ্কার করছেন। এখানে তাদের উৎপাদিত শুঁটকির মধ্যে রয়েছে লইট্টা, ছুরি, ফাইস্যা, চিংড়ি, মাইট্টা, টেংরা, সুন্দরাসহ নানা প্রজাতির মাছ অন্যতম। বৃষ্টি না থাকায় শীত মৌসুমে মাছ শুকিয়ে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। প্রতিদিন সরবরাহ চলছে সাধারণত চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, খুলনাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহর। সেখান থেকে সৌদি, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তানসহ আরো কয়েকটি দেশে রপ্তানি করা হয়। শীত মৌসুমে উৎপাদিত শুঁটকি তুলনামূলক দাম কম থাকায় আগত পর্যটকরা সাধ্যমতো কিনে বাড়ি ফিরছে। এছাড়া এখান থেকে এখন কম দামে কিনে বড় বড় গুদামে হাজার হাজার মণ শুঁটকি গুদামজাত করে বর্ষা মৌসুমেও উচ্চ দামে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে অনেক ব্যবসায়ী লাভবান হন। শুঁটকি উৎপাদনকারী শ্রমিকদের সাথে কথা হলে তারা জানান, তারা নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত। পুঁজির অভাব, সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত, শুঁটকির ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব। অন্যদিকে শুঁটকি উৎপাদনের জন্য নেই কোনো সরকারি নীতিমালা, মনিটরিং, প্রশিক্ষণ ও আধুনিক ব্যবস্থা। তাই দিন দিন এ শিল্পের উন্নতি হলেও আধুনিক এবং মানসম্মত পদ্ধতি কোনো উৎপাদকরা গ্রহণ করছেন না। শুঁটকি শিল্পে বিভিন্ন সমস্যা থাকলেও এর সাথে জড়িত বিশাল জনগোষ্ঠী মনে করে, এ মৌসুম তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। শুঁটকি শুকানোর নারী শ্রমিক রাবেয়া খাতুন বলেন, দৈনিক ৪৫০ টাকা মজুরিতে কাজ করছি। মহিলা মানুষ আর কোনো কাজ তো করতে পারব না। তাই এ কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। শ্রমিক আনোয়ার হোসেন বলেন, শীত মৌসুমে তেমন কোনো কাজ পাওয়া যায় না। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত শুঁটকির মহালে দৈনিক ৭৫০ টাকায় কাজ করি। শুঁটকি ব্যবসায়ী জানে আলম বলেন, এবার তুলনামূলক সাগরে মাছ কম মেলায় শুঁটকি উৎপাদনে কাঁচা মাছের ঘাটতি রয়েছে। গত বছরের একই দাম এবারও বাজারে। স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা মহাল থেকে পাইকারি ক্রয় করে বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকেন। বিষ, লবণবিহীন শুঁটকি হওয়ায় বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে বলে তিনি জানান। তিনি আরো বলেন, শুঁটকি মহালগুলোতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা গেলে উৎপাদন খরচ কম হবে। ফলে আরো বেশি শুঁটকি উৎপাদনে আগ্রহী হবে মৎস্য ব্যবসায়ীরা। আয় হবে কোটি কোটি টাকা। সেই সাথে সরকারও রাজস্ব পাবে বিপুল পরিমাণ। আড়ৎদাররা জানান নদী, সাগর থেকে কাঁচা মাছ সংগ্রহ করে শুঁটকি পল্লিতে নিয়ে এসে নারী শ্রমিকরা তা পরিষ্কার করেন। এরপর পরিষ্কার পানিতে মাছগুলো ধুয়ে মাচায় শুকাতে দেওয়া হয়। তিন চার দিনের রোদে তা শুকিয়ে শক্ত হয়ে যায়। প্রতিটি শুঁটকি পল্লী থেকে সপ্তাহে কয়েকশ’ মণ শুঁটকি দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান হয়। এ বিষয়ে উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা আনোয়ারুল আমিন বলেন, কুতুবদিয়ার উপকূলীয় এলাকার বিভিন্ন চরে শুঁটকি পল্লীতে সহস্রাধিক দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। জেলে ও শ্রমিক শুঁটকি উৎপাদনকারী একটি জনগোষ্ঠী তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন এই শুঁটকি উৎপাদনে। জেলে, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা যাতে নির্বিঘ্নে কাজ করে যেতে পারেন, এজন্য তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হবে। এ বছর উন্নত বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পেস্টিসাইড রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ প্রজেক্টের (মৎস্য অধিদপ্তর) উদ্যোগে বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে কুতুবদিয়া উপজেলার ১০ জন শুঁটকি উৎপাদককে আগামী মাসে উন্নত প্রযুক্তির ফিশ ড্রাইয়ার প্রদান করা হবে। বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনে মৎস্য দপ্তরের নিয়মিত মনিটরিং চলমান। বর্তমানে কুতুবদিয়া উপজেলায় বিদ্যুৎ সংযোগ থাকায় শুঁটকি উৎপাদন বিগত বছরের তুলনায় অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে এবং সরকারের সহযোগিতা থাকবে।