বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে দেশে ও বিদেশে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। গতকাল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানী শিল্পকলা একাডেমিতে ‘মায়ের কান্না’ ও ‘অগ্নি সন্ত্রাসের আর্তনাদ’ নামে দুটি সংগঠনের যৌথ আয়োজনে এসব কথা বলেন হরতাল-অবরোধ, রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।
তারা বলেন, রাজনীতি যদি মানুষের কল্যাণের জন্য হয়, তাহলে বিএনপি-জামায়াত কিসের রাজনীতি করছে। কার জন্য সাধারণ মানুষের শরীরে আগুন দিচ্ছে? তাদের এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরে রাজনৈতিকভাবে বয়কট করতে হবে।
বক্তারা বলেন, বাসে আগুন, পেট্রোল বোমা মারা কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হতে পারে না। যারা এসব করছে তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। যারা মানুষের অধিকার ফিরে দেওয়ার কথা বলে, মানুষ পুড়ে মারে তাদের রাজনৈতিকভাবে বয়কট করতে হবে, রাজনীতি করার অধিকার তাদের নেই।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াসহ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা সভা শেষ হওয়ার আগেই ওবায়দুল কাদের চলে যান। এরপর আওয়ামী লীগের কোনো নেতাই বক্তব্য রাখেননি।
অনুষ্ঠানে ২৮ অক্টোবর রাজধানী নয়াপল্টনে বিএনপি কর্মীদের হাতে নিহত পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলাম পারভেজের স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপির-জামায়াতের সহিংসতার শিকার আমার স্বামী। তার কী দোষ ছিল? কেন তাকে হত্যা করা হলো? সে তো কোন রাজনীতি করত না। তাকে কেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হত্যা করা হলো? ছয় বছরের তানহা বারবার প্রশ্ন করে, বাবা কবে আসবে? কোনো পুলিশ সদস্য টাকা দিলে সেই টাকা সে জমিয়ে রাখে এবং টাকা জমিয়ে তার বাবাকে সে কিনে আনবে বলে। বড় হয়ে আমার মেয়ে পুলিশ হবে এবং বাবার হত্যার বিচার করবে। আমার দুই সন্তান তাদের বাবার লাশ ধরতে পারেনি। তাদের এখন একটাই প্রতিজ্ঞা পুলিশ হয়ে বাবা হত্যার বিচার করা। পুলিশ দেখলেই সে তার বাবাকে খোঁজে।
নভেম্বর মাসে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে বাসে দেওয়া আগুনে মারা যান ওই বাসের হেলপার আবু নাঈম। তার মা বলেন, আমার ছেলে তো রাজনীতি করত না। কেন তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো? তার বাবা সংসারের হাল ধরতে পারেনি তাই নাঈম বাসের হেলপারি শুরু করে। পুরো পরিবারের খরচ বহন করত সে। তাকে হারানোর পর পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের হত্যার শিকার যুবলীগের আজাদের ভাই বলেন, আমি রাস্তায় গেলে আমাকে হত্যা করবে, তাই আমার পরিবার আমাকে রাস্তায় বের হতে দেয় না। এমন শঙ্কায় আমরা জীবন পার করছি।
মনোহরদী উপজেলার ব্যবসায়ী সায়েম বলেন, ২০১৩ সালে রাস্তায় গাছ ফেলে অবরোধ করেছিল বিএনপি-জামায়াতের লোকজন। এই সময় একজন মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল যেতে চাইলে তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। এতেই আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়ে দেয় তারা। এরপর আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।
ঢাকা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট খোদেজা নাসরিন। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাহবাগে বিহঙ্গ বাসে পেট্রোল বোমা মারা হয়। সেই বাস থেকে কোনোভাবে বের হলেও সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন তিনি। তিনি বলেন, সে দিনের আগুনে আমার দুটি হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। মানবাধিকার দিবসে আমার একটাই দাবি, এসব অগ্নি-সন্ত্রাস যারা করছে তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হোক।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের সালাউদ্দিন বলেন, ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি কোনাবাড়িতে গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। সেই আগুনে আমি পঙ্গুত্ব বরণ করি। এরপরও বিএনপি-জামায়াতের আগুন সন্ত্রাস থামেনি। তাদের আগুনে সারা দেশ জ্বলছে। সাধারণ মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে তারা কী ফায়দা হাসিল করতে চায়? রাজনীতির নামে যারা এই সন্ত্রাস করছে তদের রাজনীতি বন্ধ করে দিতে হবে। আগুনের পর আমার চেহারার দিকে তাকাতে পারি না। আমি মুখ লুকিয়ে রাখি। আমি কোথাও চাকরি পাই না। ছেলে-মেয়েকে পড়ালেখা করাতে পারি না। হাত দিয়ে কোনো কিছু ধরতেও পারি না।
২০১৫ সালে দিনাজপুরে বাসে দেওয়া আগুনে পঙ্গুত্ব বরণ করেন ঠাকুরগাঁওয়ের রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমি বাসের ড্রাইভিং করছিলাম। দিনাজপুরে বাসে পেট্রোল বোমা মারার পর আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমি রাজনীতি করতাম না। কারা এখন বাসে আগুন দিচ্ছে? তারা কী চায়? তাদের সন্ত্রাসের কথা বিদেশে প্রচার করুন।
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের নামে বিমান বাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য গুমের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় ‘মায়ের কান্না’ সংগঠন। ১৯৭৭ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাইদুর রহমান মিঞার ছেলে মো. কামরুজ্জামান মিঞা লেলিন এ সংগঠনের সমন্বয়ক। তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পরিকল্পিতভাবে একটি অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। পরবর্তীতে তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে জিয়াউর রহমান একদিনের সামরিক আদালতে বিচার করে সেই রাতেই ফাঁসি সম্পন্ন করতেন নিরপরাধ সামরিক সদস্যদের। রাতের আঁধারে কারফিউ দিয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর ও বগুড়া কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হতো। আমরা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার দাবি করছি। একই সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করায় তার গড়া দল বিএনপিকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানাচ্ছি।