কক্সবাজারের স্বপ্নের ট্রেনের টিকিটে সিন্ডিকেটবাজী

প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

কক্সবাজারের ঝিংলজায় অবস্থিত আইকনিক রেলস্টেশনে টিকিট কাউন্টারের সামনে গতকাল বুধবার সকাল ৮টার আগেই ভীড় করছিলেন কিছু সংখ্যক মানুষ। পূর্ব নির্ধারিত ঘোষণা মতে আগামী ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে ঢাকাগামী কক্সবাজার এক্সপ্রেসের কোনো টিকিট খালি নেই। গতকাল সকালে বিক্রি হবে ২৩ ডিসেম্বরের টিকিট।

কিন্তু না ২৩ ডিসেম্বরের কোনো টিকেটও পাওয়া যায়নি। সকাল ৮টার পর পর কাউন্টারে এসে সংশ্লিষ্টরা জানিয়ে ছিলেন সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আর ৮টায় ২টি রেলওয়ের অনলাইন টিকিট বিক্রির অ্যাপে দেখা যায় সেখানেও সব টিকিট বিক্রি দেখানো হয়েছে।

টিকিটের এ পরিস্থিতি শুরু হয়েছে ১ ডিসেম্বর থেকেই। কক্সবাজার থেকে ঢাকা প্রথম যাত্রী নিয়ে রেল চলাচলের পর থেকে এই টিকিটকে নিয়ে কক্সবাজারে শুরু হয়েছে হৈ-চৈ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে এটা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজারে রেলের টিকিট শতভাগ কালোবাজারী সিন্ডিকেটের দখলে চলে গেছে। আর অতিরিক্ত দেড় থেকে ২০০ টাকা দেয়া হলেই মিলছে টিকিট।

যার সূত্র ধরে প্রতিবেদক গত ৬ ডিসেম্বর থেকে টানা এক সপ্তাহ ধরে এই টিকিট নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। যেখানে প্রতিদিনই কাউন্টারে গিয়ে মিলেনি কোনো টিকিট আর অনলাইনেও ৮টা ১ বা ২ মিনিটের মধ্যে উধাও হয়ে যায় সব টিকিট।

কিন্তু কোনো টিকিট কাউন্টারে বা অনলাইনে পাওয়া না গেলেও গত বৃহস্পতিবার কক্সবাজার থেকে ট্রেনযোগে স্বপরিবারে ঢাকা গেছেন কক্সবাজারের ঘোনারপাড়া এলাকার এক ব্যবসায়ী। ওই ব্যবসায়ীর ভাই বার্তা সংস্থা ইউএনবি কক্সবাজারের প্রতিনিধি দীপক র্শমা দীপু।

দীপক র্শমা দীপু জানান, গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ট্রেন যাত্রা দেয়ার আগে তার ভাই, ভাবি ও ২ সন্তানসহ স্টেশনে যান। যেখানে টিকেটের জন্য কয়েকজনকে আকুতি জানানোর পর একজন ৪টা টিকিটে ২০০ টাকা করে বেশি দিলে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ভাই তার শর্তে রাজী হলে লোকটি স্টেশনের ভেতরে গিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ২টি টিকিট নিয়ে ফেরত আসেন। ওই টিকিটে করেই ৪ জন ঢাকা গিয়েছিলেন। এই লোকটির পরিচয় নিশ্চিত না হলে লোকটি স্টেশন সংশ্লিষ্ট বলে ধারণা করেন সাংবাদিক দীপক শর্মা। গত শনিবার দুপুরে আইকনিক স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় যাত্রীরা ভেতরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। সাড়ে ১২টার ট্রেনে এসব যাত্রীরা যাবেন ঢাকায়। যাদের আগে থেকেই টিকিট করা ছিল তারা সানন্দে অপেক্ষা করছে স্টেশনে। তবে কাউন্টারে টিকিট নেই ঝুলানো নোটিশ দেখে বিরক্তভাবে এদিক সেদিক ঘুরছে অসংখ্য যাত্রী। টিকিট পেতে দায়িত্বরত অনেকের সঙ্গে কথা বলছেন তারা। ফিরেও যাচ্ছেন অনেকে। টিকিট না পাওয়া এমন যাত্রীদের টার্গেট করছে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) ইউনিফর্ম পরিহিত কয়েকজন সদস্য। টার্গেটের গা ঘেঁষে কথা বলছেন তারা। কথা শেষে আইকনিক স্টেশনের ভেতরে যাচ্ছেন একটুখানি পর ফিরে এসে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন রেলের টিকিট। রেল কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে টিকিট এনে দিচ্ছেন নিরাপত্তা কর্মীরা। টিকিট নেয়া যাত্রী আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, এক লোক থেকে চারটি টিকিট সংগ্রহ করেছি। এক নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ওই লোকের কাছে নিয়ে গেছে। ২৭০০ টাকা দিয়ে এই টিকেটগুলো কিনেছি। শুধু মামুন নয়, কথা হয় ছুটিতে বাড়ি যাওয়া রেলস্টেশনে অপেক্ষারত দুইজন সৈনিকের সঙ্গে। তারাও জানান, বাড়তি দাম দিলে টিকিট দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন ওই আরএনবি সদস্য।

এবার যাত্রী সেজে কথা হয় কালোবাজারি সিন্ডিকেটের সদস্য হেলাল নামের ওই আরএনবি সদস্যের সঙ্গে। ঢাকা যাওয়ার টিকিট চাইলে প্রতিবেদককেও দুটি টিকিট ২২০০ টাকা দিয়ে বিক্রির প্রস্তাব দেন তিনি। টিকিটের বিষয়ে গত ৯ ডিসেম্বর কথা হয় কাউন্টারের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হাসিবুলের সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতিদিন অতিরিক্ত ১ হাজারের বেশি যাত্রী আসে। ১৯ তারিখ বন্ধ। ২০ তারিখের টিকিট পাওয়া যাবে রোববার ১০ ডিসেম্বর। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর গিয়েও পাওয়া যায়নি ২০ ডিসেম্বরের সেই টিকিট। আর এর মধ্যে সিন্ডিকেট প্রতিদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পেইজ, গ্রুপ এবং হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ করে অতিরিক্ত দামে বিক্রি করছেন টিকিট। ‘ঢাকা টু কক্সবাজার ট্রেন’ ‘কক্সবাজার ঢাকা কক্সবাজার ট্রেন টিকিট ক্রয়-বিক্রয় গ্রুপ’ ‘ট্রেন টিকিট বাংলাদেশ রেলওয়ে’ নামে ফেসবুকে কয়েকটি পেইজ ও গ্রুপে চক্রটিকে সক্রিয় দেখা গেছে। সেখানেও অতিরিক্ত টাকা দিলে মিলে ট্রেনের টিকিট। কিন্তু এই টিকিট নেপথ্যের কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশনের মাস্টার মো. গোলাম রব্বান। তিনি বলেছেন, কালোবজারে টিকিট যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ট্রেনের টিকিট মূলত শতভাগই অনলাইনে নিয়ন্ত্রিত। যা নিয়ন্ত্রণ করা হয় ঢাকা থেকে। ১০ দিন আগের টিকিট সকাল ৮টায় অনলাইনে আসে। কিন্তু এ টিকিট কাটার জন্য প্রতিদিন সকাল ৮টায় লাখের বেশি মানুষ চেষ্টা করে। এক হাজার ১০টি সিট। একজন তার এনআইডির বিপরীতে ৪টা করে টিকিট কাটতে পারেন। ফলে অনেকেই টিকিট পাচ্ছেন অনেকেই পাচ্ছেন না। কাউন্টারেও একই অবস্থা। কোনো কারণে কেউ টিকিট ছেড়ে দিলে তা কাউন্টারে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে টিকিট কেটে অনেকেই না গিয়ে অন্যজনকে বিক্রি করছেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, এরইমধ্যে একজনের এনআইডির বিপরীতে অন্যজন ভ্রমণের বিষয় দেখা গেছে। এজন্য ট্রেন কর্তৃপক্ষ জরিমানাও আদায় করেছেন।