সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত আজো অম্লান

প্রকাশ : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

স্বাধীনতার ৫২ বছর উদযাপন করছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের আজকের এ দিনে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বিকাল ৪টা ৫৫ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দান) আত্মসমর্পণের দলিলে সই করে। আত্মসমর্পণের দলিলের প্রতিটি শর্তই বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনী ঠিক করেছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী এসব শর্তের বেশ কিছু বিষয়ে আপত্তি করলেও তা মানা হয়নি।

পাকিস্তান চেয়েছিল আত্মসম্পর্ণের অনুষ্ঠান গোপনে আয়োজন করতে। কিন্তু ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব জানিয়ে দেন, অনুষ্ঠান হবে প্রকাশ্যে। জ্যাকব জানান, আত্মসম্পর্ণের দলিলটি যেন অসম্মানজনক না হয়, সেদিকে নজর রাখা হয়েছিল। এতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর পক্ষে সই করেন কমান্ডার-ইন-চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, আর যুদ্ধরত পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছিলেন তখনকার বিমান বাহিনীর প্রধান ও মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার।

আত্মসমর্পণের দলিলে যা লেখা ছিল

পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশি যৌথ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে, পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সব সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্রসমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে। এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে, তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।

আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের সেই টেবিলটি জাতীয় জাদুঘরে

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের (সারেন্ডারের) দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার সেই টেবিলটি এখন জাতীয় জাদুঘরে। যারাই জাতীয় জাদুঘরে যান, সেই টেবিলটির সামনে গেলেই থমকে দাঁড়ান। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের এক অমূল্য সাক্ষ্য। স্বাধীনতার গুরুত্বপূর্ণ দলিল। জাতীয় জাদুঘরে রাখা তিন হাত বাই দেড় হাত সেই টেবিলটি। ওপরে কাঠে, চারদিকে ঢেউ-খেলানো নক্সা। পায়ার নক্সা বলতে লম্বা দুটি খাজ। বিশেষ কোনো কারু কাজ নেই। পায়াগুলো ক্রমশ ওপর থেকে নিচের দিকে সরু। ঢাকা ক্লাব থেকে আনা হয়েছিল সেদিন সেই টেবিলটি। মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্তের সাক্ষ্য সেই টেবিলটির ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে কারা, কীভাবে এনে দিল তারও একটি ইতিহাস আছে, যা অনেকেরই অজানা। আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেন পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল এএকে নিয়াজী। পাশে বসা মিত্রবাহিনীর লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। আত্মসমর্পণের আগে-পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মূল দুশ্চিন্তা ছিল নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে। তারা শঙ্কিত ছিল, নয় মাসের গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের কারণে ক্রুদ্ধ মুক্তিবাহিনী আর জনতা তাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে পারে। ১৬ ডিসেম্বর দুপুরে ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তানী ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টারে মিত্রবাহিনীর মেজর জেনারেল জ্যাকব আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়াজীর মধ্যে আত্মসমর্পণ চুক্তি নিয়ে যখন দর কষাকষি চলছে, তখন পাকিস্তানি বাহিনীর নিরাপত্তা ছিল আলোচনার একটা বড় বিষয়। ঢাকায় তখন পাকিস্তানি সৈন্য আর নানা রকম আধাসামরিক বাহিনীর লোকজন মিলিয়ে ৯৪ হাজার সদস্য আটকা পড়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জেএফআর জ্যাকব তার স্যারেন্ডার এ্যাট ঢাকা : বার্থ অব আ নেশন বইয়ে লিখেছেন, পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এএকে নিয়াজী রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ না করে সেনানিবাসে তার সদর দপ্তরেই আত্মসমর্পণের ব্যাপারে চাপাচাপি করছিলেন। কাদের সিদ্দিকী (বীর উত্তম) তার স্বাধীনতা ’৭১ বইয়ে লিখেছেন, এই ভীতি যে খুব অমূলক ছিল, তাও নয়। ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আর নিয়াজীকে বহনকারী গাড়ি যখন লাখ লাখ জনতার ভিড় ঠেলে রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগোচ্ছিল, তখন একাধিকবার সেই বহরের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। ক্ষিপ্ত জনতা নিয়াজীকে ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। তারা বলছিল, ‘নিয়াজীকে আমাদের হাতে দাও। ও খুনি। ও আমাদের লাখ লাখ লোক মেরেছে, আমরা ওর বিচার করব।’ জ্যাকব লিখেছেন, আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনায় সাব্যস্ত হয়, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হলেও নিয়াজী ও তার বাহিনী তখনই অস্ত্র সমর্পণ করবে না। জেনারেল জ্যাকব ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি দেন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবন্দি হলেও ঢাকা সেনানিবাসে তাদের অবস্থান ছিল সশস্ত্র। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে তড়িঘড়ি করে আয়োজন করা হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠান। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তানি ও ভারত-দুই বাহিনীর শীর্ষ সেনা কর্মকর্তারা তৈরি। সামরিক আয়োজনও প্রায় শেষ। কিন্তু দলিলে সই করতে গেলে লাগবে একটি টেবিল। তড়িঘড়ি করে সেটাও জোগাড় করে ফেলতে হবে। কিন্তু সেই টেবিলটি আনার দায়িত্ব নিয়েছে কে? মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে গেরিলা অপারেশন চলছিল ঢাকায়। ঢাকার গ্রীনরোড, কলাবাগান, গ্রীনসুপার মার্কেট, নীলক্ষেত প্রভৃতি জায়গায়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করবে তা মুহূর্তের মধ্যেই খবর পায় আব্দুল আজিজের নেতৃত্বাধীন গেরিলা বাহিনী। গেরিলা বাহিনীর একজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মাহমুদ বাবলু। পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলটি যেই টেবিলে রেখে স্বাক্ষর করা হয়েছিল সেই টেবিলটি ঢাকা ক্লাব থেকে এনে দিয়েছিলেন সেই মুক্তি বাহিনীরাই। মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরটি পেয়ে যায় আগেই। অস্ত্র নিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকালেই একটা খোলা জিপে অবস্থান নেয় ঢাকা ক্লাবের কাছে, বটগাছের নিচে। মুক্তিযোদ্ধা বজলুল মাহমুদ বাবলুর দেয়া সাক্ষাতকারে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা জাহেদ আনোয়ার ছিলেন ড্রাইভিংয়ে। সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মিলুও ছিল। ইন্ডিয়ান আর্মিরা বিমানে লিফলেট ছড়াচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কয়েকটা ভারতীয় মিগও চলে যায়। রমনা রেসকোর্স ময়দানটি ঘিরে আছে আত্মসমর্পণের শ্বাসরুদ্ধকর ক্ষণ। রমনা রেসকোর্স ময়দান, এখন যেখানে শিশু পার্ক ছিল, তার ভেতরেই হয়েছিল আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানটি। ইন্ডিয়ান আর্মিদের কয়েকজন এসে বলল একটা টেবিল দরকার। তখন ঢাকা ক্লাব থেকে বের করে আনা হলো একটি টেবিল। সেই টেবিলেই ইতিহাস হয়ে গেল। আত্মসমর্পণের (সারেন্ডারের) অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দুই নম্বর সেক্টরের অধীনে আব্দুল আজিজের নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা। একটি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণে স্বাক্ষর করা সেই টেবিলটি। টেবিলটির সঙ্গে ইতিহাস হয়ে গেল টেবিল আনয়নকারী মুক্তিবাহিনীরাও। হাজারো আনন্দ মুহূর্ত একসঙ্গে মিলে একাকার হয়ে ঐতিহাসিক আনন্দের স্রোতের ধারায় মিলে গেল ১৬ ডিসেম্বরের দিনটিতে।