চট্টগ্রাম নগরীতে বাড়ছে কিশোর অপরাধ। কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতায় খুনোখুনির ঘটনাও বেড়ে চলেছে। গত বৃহস্পতিবার নগরীর বন্দরটিলা থেকে এক কিশোরের বস্তাবন্দি মরদেহ উদ্ধার করা হয়। সেই ঘটনার সাথেও যুক্ত আছে কিশোর অপরাধ। এক কিশোরের আঘাতে খুন হয় আরেক কিশোর। সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে সাজানো হয় অপহরণ নাটক। তবে শেষ পর্যন্ত খুনি কিশোর ও তার মাকে গ্রেপ্তারের পর পুরো ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়ে।
জানা গেছে, গত বুধবার বিকালে নগরীর বন্দরটিলা এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় কিশোর আবদুল্লাহ। পরে তার খোঁজ না পওয়ায় আবদুল্লাহর বাবা ইপিজেড থানায় মামলা করেন। এরই মধ্যে ওই কিশোরের মুক্তির বিনিময়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণও দাবি করা হয়। তবে পরে বেরিয়ে আসে তুচ্ছ ঘটনায় কিশোর বন্ধুর হাতে খুন হয়েছে কিশোর আবদুল্লাহ।
পুলিশ জানায়, ‘ফ্রি ফায়ার গেম’ খেলা নিয়ে দুই বন্ধুর মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে মারামারিতে রূপ নিলে একজনের ঘুষিতে অন্যজনের মৃত্যু হয়। খুনি সন্তানকে খুনের দায় থেকে বাঁচাতে লাশ গুমের চেষ্টা করেন তার মা হাফিজা বেগম (৩৬)। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। মা ও তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ।
গতকাল সকালে নগরীর মনসুরাবাদে নগর গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান উপকমিশনার (বন্দর ও পশ্চিম) আলী হোসেন। এর আগে বৃহস্পতিবার অভিযান চালিয়ে খুনের সঙ্গে জড়িত ওই কিশোর ও তার মা হাফিজা বেগমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার আলী হোসেন বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকালে ইপিজেড থানার বন্দরটিলা এলাকায় আবদুল্লাহ নামে ১৩ বছর বয়সি এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিক তদন্তে তাকে খুন করা হয়েছে বলে আমরা জানতে পারি। পরে খুনের সঙ্গে জড়িত আসামিদের ধরতে আমরা অভিযানে নেমে পড়ি। ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ ও তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে এক কিশোরসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হই আমরা। তারা দুইজনই সম্পর্কে মা-ছেলে।
তিনি আরো বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার ওই কিশোর জানিয়েছে নিহত আবদুল্লাহ ও সে একসঙ্গে বন্দরটিলার হাবীবীয়া তাজবিদুল মাদ্রাসায় পড়েছে। তখন থেকেই তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। পরে আবদুল্লাহ গ্রামের বাড়ি বরিশালে চলে যায়। পরীক্ষা শেষে সে বাবা-মায়ের কাছে বেড়াতে এসেছিল। তখন তাদের সঙ্গে আবার দেখা হয়। এরপর আবদুল্লাহকে নিয়ে ওই কিশোর তার বাসায় আসে। তখন বাসায় কেউ ছিল না। ওই কিশোরের মা চাকরিতে গিয়েছিল। একসঙ্গে খাবার খায় দুইজনই। মায়ের রেখে যাওয়া মোবাইলে ফ্রি ফায়ার গেইম খেলার একপর্যায়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। পরে সেটা মারামারিতে রূপ নেয়।
আলী হোসেন বলেন, মারামারির একপর্যায়ে আবদুল্লাহর গলার শ্বাসনালীতে জোরে ঘুষি মারে ওই কিশোর। সঙ্গে সঙ্গেই সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। মাথায়ও আঘাত পায় সে। তখন আবদুল্লাহ পানি খেতে চাইলে ওই কিশোর তাকে পানিও খাওয়ায়। সাহায্যর জন্য ওই ভবনের চার তলায় এক বন্ধুর কাছে গেলেও কোনো প্রকার সহযোগিতা ওই কিশোর পায়নি। এরই মধ্যে আবদুল্লাহ মারা যায়। পরে সে তার মাকে কল দিয়ে বিষয়টি জানায়।
এরই মধ্যে ওই কিশোর আবদুল্লাহর বাবাকে কল দিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায় যাতে তাকে কেউ সন্দেহ না করে। মুক্তিপণের টাকা যোগাড় করতে করতে যাতে পালিয়ে যেতে পারে সেজন্যই আবদুল্লাহ বাবাকে কল দিয়েছিল সে। বয়সে কিশোর হলেও মানসিকভাবে সে আরো এগিয়ে। টিভি সিরিয়াল দেখে সে এসব শিখেছে বলে জানিয়েছে।
পুলিশের এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গ্রেপ্তার ওই কিশোরের মা সন্ধ্যায় বাসায় এসে ছেলেকে বাঁচাতে মরদেহ বস্তাবন্দি করে গুম করার পরিকল্পনা করে। পরে সুযোগ বুঝে আবদুল্লাহর বস্তাবন্দি মরদেহ রাত ২টার দিকে দুই ভবনের মাঝে ফেলে দেয়। এরপর ওই কিশোরকে আনোয়ারায় তার খালার বাড়িতে রেখে অফিস করতে চলে যায় তার মা। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে প্রথমে তার মা ও পরে ওই কিশোরকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এদিকে ছেলেকে পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে- দাবি করে আবদুল্লাহর বাবা মাহমুদ হোসেন তালুকদার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার একমাত্র ছেলে। আমার স্ত্রী ও আমি চাকরি করায় তাকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। গত সোমবার (১১ ডিসেম্বর) সে পরীক্ষা শেষে আমাদের বেড়াতে এসেছিল। আমরা গত বৃহস্পতিবার সকালে দুইজনেই চাকরিতে চলে গিয়েছিলাম। বাসায় সে একা ছিল। বিকালে আমার কাছে একটি কল আসে। কল রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমার ছেলেকে অপহরণ করেছে বলে জানিয়ে কল কেটে দেয়। আবার কল দিয়ে বলে ১০ লাখ টাকা না দিলে আমার ছেলেকে তারা মেরে ফেলবে। এভাবে করে তিনবার কল দেয় সে।
তিনি বলেন, মোবাইলে যখন কথা বলছিলাম আমার একমুহূর্তের জন্য মনে হয়নি, এটা কোনো শিশু বা কিশোরের গলা। আমার ছেলেকে পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে। আমার ছেলেকে যারা খুন করেছে, আমি তাদের বিচার চাই।