ফিলিস্তিনের গাজায় সংঘাতে লিপ্ত সব পক্ষের প্রতি পর্যাপ্ত ত্রাণ সরবরাহের সুযোগ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। গত শুক্রবার এ নিয়ে ভোটাভুটির পর প্রস্তাবটি পাস হয়। তাতে গাজায় ‘নিরাপদে ও বাধাহীনভাবে পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ করে দিতে’ চলমান সংঘাতে জড়িত সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে ওই প্রস্তাবটি তুলেছিল সদস্য দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত। প্রথমে তাতে ‘অবিলম্বে লড়াই বন্ধের’ আহ্বানের কথা বলা হয়েছিল। তবে গত কয়েক দিনে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে প্রস্তাবের ভাষায় বেশ কাটছাঁট করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার পাস হওয়া প্রস্তাবে ‘লড়াই বন্ধের আহ্বান’ কথাটি এড়িয়ে ‘লড়াই বন্ধে উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরির’ আহ্বান জানানো হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদে এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে ১৩টি। ভোটদানে বিরত ছিল পরিষদের স্থায়ী সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া। ভোট না দিলেও জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস বলেছেন, ‘প্রস্তাবটি অগ্রগতির পথে একটি শক্ত পদক্ষেপ।’ তবে প্রস্তাবের ভাষা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে রাশিয়া। ভাষাগত আপত্তির কথা তুলেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতও। জাতিসংঘে দেশটির রাষ্ট্রদূত লানা জাকি নুসেইবেহ বলেছেন, ‘আমরা জানি প্রস্তাবের ভাষাটা একদমই যথাযথ নয়। মানবিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো থেকে আমরা কখনোই বিরত থাকব না।’ গত ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। হামলা এ পর্যন্ত উপত্যকাটিতে ২০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮ হাজার শিশু ও ৬ হাজার ২০০ জন নারী। এছাড়া খাবার, পানি ও জ্বালানির অভাবে চরম দুর্দশার মধ্যে রয়েছেন গাজার বাসিন্দারা। গাজায় চলমান সংঘাত নিয়ে এর আগেও নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব তোলা হয়েছে। তবে একটিও পাস হয়নি। এর মধ্যে সবশেষ প্রস্তাবে উপত্যকাটিতে ‘অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির’ আহ্বান জানানো হয়েছিল। সেবাও প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল ১৩ সদস্য। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করায় তা খারিজ হয়ে যায়। আর ভোট দানে বিরত ছিল যুক্তরাজ্য। এদিকে গাজায় অতিকায় বোমা দিয়ে হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। এসব বোমার কোনোটির ওজন দুই হাজার পাউন্ড। এমন প্রায় পাঁচ শতাধিক অতিকায় বোমা দিয়ে গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে প্রাণহানি যেমন বেশি হচ্ছে তেমনি ধ্বংসযজ্ঞ হচ্ছে বড় ধরনের। ইসরাইল এমন শত শত বোমা গাজায় ছুড়েছে। সমরবিদরা বলছেন, এসব বোমা যেখানে আঘাত হানে তার আশপাশে এক হাজার ফুটের বেশি দূরত্বে থাকা লোকজনেরও প্রাণহানি নয়তো আহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে গাজায় বোমার আঘাতে হওয়া পাঁচ শতাধিক গর্ত দেখা গেছে ছবিতে, যেগুলোর পরিধি ৪০ ফুটের বেশি। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরাইলের ছোড়া দুই হাজার পাউন্ডের বেশি ওজনের বোমার আঘাতে এসব গর্ত তৈরি হয়েছে। ইরাকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের বিরুদ্ধে মার্কিন সামরিক বাহিনী যেসব বোমা ব্যবহার করেছিল, তার চেয়ে এই বোমা আরও ধ্বংসাত্মক বলে মত সামরিক বিশ্লেষকদের। গাজায় ইসরাইলের অব্যাহত হামলায় প্রতিদিন যে বহু প্রাণহানি হচ্ছে তার পেছনে ইসরাইলের ছোড়া এই অতিকায় বোমা হামলার মিল খুঁজে পাচ্ছেন তারা। অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় প্রায় ৬ লাখ মানুষ বিপর্যয়কর ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছেন এবং আগামী ৬ মাসের মধ্যে সেখানে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি রয়েছে বলে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) রিপোর্টে এই তথ্য ওঠে এসেছে। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সি এই খবর জানিয়েছে। আইপিসি’র ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ জনেরও বেশি মানুষ ‘বিপর্যয়কর ক্ষুধার’ সম্মুখীন হয়েছেন। আর তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সংকটে রয়েছেন গাজার অঞ্চলের সবাই। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি-সহ জাতিসংঘের অন্যান্য সংস্থা ও বেসরকারি সংস্থার (এনজিও)-এর তথ্যের ভিত্তিতে এই রিপোর্ট তৈরি করেছে আইপিসি। আইপিসি একটি বহু-অংশীদার ভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম যা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বৈজ্ঞানিক মান অনুযায়ী ক্ষুধা সংকটের তীব্রতা এবং মাত্রা নির্ধারণ করতে তথ্য বিশ্লেষণ করে থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গাজার প্রায় ৫ লাখ ৭৬ হাজার ৬০০ মানুষ যা মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশ তাদের খাদ্য সরবরাহ এবং সংকট মোকাবিলা করার সক্ষমতা শেষ হয়ে গেছে এবং তারা বিপর্যয়কর ক্ষুধা (আইপিসি ফেজ ৫) এবং অনাহারের সম্মুখীন হয়েছেন।’ ডব্লিউএফপির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর সিন্ডি ম্যাককেইন বলেছেন, ‘কয়েক সপ্তাহ ধরেই আসন্ন এই বিপর্যয়ের বিষয়ে সতর্ক করে এসেছে ডব্লিউএফপি। দুঃখজনকভাবে নিরাপদ ও ধারাবাহিক সরবরাহের সুযোগ ছাড়াই আমরা সহায়তার বিষয়ে আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছি। সেখানকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ, গাজার কেউই অনাহার থেকে নিরাপদ নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘তীব্র সংঘাত এবং সীমিত মানবিক সহায়তার প্রবেশাধিকার’ যদি বর্তমান পরিস্থিতির মতো চলতে থাকে, তবে আইপিসি ভবিষ্যদ্বাণী করছে, ‘আগামী ছয় মাসের মধ্যে সেখানে দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি রয়েছে।’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডব্লিউএফপি খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা এরইমধ্যে জানিয়েছেন, সংঘাতের মধ্যে বেঁচে থাকতে গাজাবাসীরা ‘তাদের সব সম্পদই ব্যবহার করেছে, সেখানে জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে, বেকারিগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, দোকানগুলোও খালি এবং মানুষ খাবার খুঁজে পাচ্ছে না।’ ডব্লিউএফপি কর্মীদের গাজার ফিলিস্তিনিরা জানিয়েছেন, প্রায় পুরো দিনই না খেয়ে থাকতে হয় তাদের। এমনকি অনেক প্রাপ্তবয়স্করা নিজে না খেয়ে থাকেন যাতে শিশুরা কিছু খেতে পায়। ডব্লিউএফপির প্রধান অর্থনীতিবিদ আরিফ হোসেন বলেছেন, ‘এগুলো কেবল সংখ্যা নয়- এই উদ্বেগজনক পরিসংখ্যানগুলোর পেছনে আলাদাভাবে নারী, শিশু এবং পুরুষরা রয়েছেন। এই সংকট নজিরবিহীন জটিলতা, মাত্রা এবং দুর্ভোগের সৃষ্টি করেছে।
‘শুধু সহায়তা দিলেই গাজায় সমস্যার সমাধান হবে না’ : গাজায় শুধু সহায়তা দিলেই সেখানকার সব সমস্যার সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেছেন অক্সফাম আমেরিকার প্রধান স্কট পল। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, যখন সেখানকার বাড়িঘর, কল-কারখানা, খামার, মিল এবং বেকারিতে ক্রমাগত বোমা হামলা চালিয়ে সবকিছু ধ্বংস করা হচ্ছে তখন সহায়তা আসলেই কোনো কাজে আসবে না।
দারিদ্র্য ও অবিচারের অবসান ঘটাতে বিশ্বব্যাপী বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে অক্সফাম নামের এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠানটি। পল বলেন, গাজায় আটা বা ময়দা সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু আপনি যদি সেগুলো দিয়ে খাবার তৈরি করতে না পারেন বা খাবার তৈরির পরিস্থিতি যদি না থাকে তবে সেখানে এগুলো কোনো কাজে আসবে না। তাই এখন যে বিষয়গুলোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে তা পুরোপুরি ভুল বলা যায়।
তিনি বলেন, গাজায় আসলে কী প্রয়োজন তা নিয়ে বাইডেন প্রশাসন এবং বাকি বিশ্বের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। বেশিরভাগ দেশ তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিকে সমর্থন করছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছে।
পল বলেন, ত্রাণসামগ্রী বিতরণের প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা সমাধান করা জরুরি। তিনি বলেন, সেখানে কতগুলো ত্রাণবাহী ট্রাক পৌঁছেছে তা নিয়ে কথা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের উচিত কতজন জীবন হারিয়েছে এবং আমাদের আশপাশে যেসব অমানবিক ঘটনা ঘটছে সেসব নিয়ে কথা বলা। দুই মাসের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা। কিন্তু তারপরও বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি বাহিনী। সবশেষ নুসিরাত শরণার্থী শিবির ও খান ইউনুসে হামলার খবর পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান সতর্ক করে জানিয়েছেন, গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন হয়ে পড়ছে। কারণ তীব্র লড়াইয়ের কারণে মানবিক সহায়তাসহ কোনো কিছুই সেখানে পাঠানো যাচ্ছে না। যদিও গাজায় মানবিক সহায়তা পাঠাতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। তবে মানবিক সংগঠনগুলো বলছে, যুদ্ধবিরতির দাবি ছাড়া কোনো কিছুই যথেষ্ট হতে পারে না।