শিক্ষাজীবন শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষিতে মনোনিবেশ করেছেন ঠাকুরগাঁওয়ের যুবক মো. মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী। কৃষি অধিদপ্তরের পরামর্শে বাণিজ্যিকভাবে কৃষি ও বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি উৎপাদন করে ব্যাপক সাফল্য ও বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। সদর উপজেলার রাজাগাঁও ইউনিয়নের চামেশ্বরী গ্রামের মৃত হামির উদ্দিন সরকারের ছেলে মো. মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী। পড়াশোনা শেষ করে ২০০০ সালে মাত্র ৫০ শতক জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে সবজি আবাদ শুরু করেন। এভাবে কৃষিতে আশার সম্ভাবনা দেখে এখন তিনি প্রায় ৫০ একর জমিতে চাষাবাদ করছেন। বাংলাদেশে কৃষিক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় ও তার উৎপাদিত সবজি বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখছে। এজন্য তিনি স্থানীয় পর্যায়সহ বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ও এআইপি সম্মাননা পেয়েছেন। এতে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন তিনি। দেখা যায়, শুধু বিষমুক্ত নিরাপদভাবে কপি, মুলা, লাউ, করলাসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি প্রায় ১০ থেকে ১২ একর জমিতে চাষ করেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন ফলের বাগান, মৌ চাষ, বিডি-২ জাতের চা চাষসহ আলু, গম, ধান ও বাড়িতে পশুপাখির খামারসহ পুকুরে মাছও চাষ করেন। বলা যায়- এমন কিছু বাকি নেই যে, তা তিনি চাষ করেন না। তার এসব কৃষি খামারের জন্য অনেকের কর্মসংস্থান তৈরির পাশাপাশি ব্যাপক সুনাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন এই উদ্যোক্তা। তার উৎপাদিত সবজি বিষমুক্ত হওয়ায় এর চাহিদা অনেক বেশি। তাই দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও রপ্তানি হয় এসব সবজি। এমনকি বিভিন্ন জেলা থেকে তার খামার দেখতে ও পরামর্শ নিতে ছুটে আসেন অনেকে। তার এমন সফলতা দেখে স্থানীয় অনেক কৃষক ও তরুণ উদ্যোক্তারা তার কাছে পরামর্শ নিয়ে কৃষিতে অগ্রসর হচ্ছেন। স্থানীয় কৃষক মো. আবুল হোসেন বলেন, মেহেদীর দেখে আমাদের আশপাশের অনেক মানুষ কৃষিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাষাবাদ করছেন। দারাস তুল্লাহ নামে এক কৃষক বলেন, মেহেদী ভাই কীটনাশক মুক্তভাবে বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ করেন। তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে আমিও এখন কৃষি করে লাভবান হচ্ছি। শুধু আমি না তার কাছে পরামর্শ নিয়ে এখন এই দিকের অনেক মানুষ কৃষি করছেন। স্থানীয় কুরবান সরকার লিয়ন নামে এক যুবক বলেন, মেহেদী ভাই বিষমুক্তভাবে সবজি উৎপাদন করে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছেন। জাতীয় পর্যায়ে পদক ও সম্মাননা অর্জন করছেন। তার দেখে এখন আমরাও এলাকার অনেক যুবক কৃষিতে মনোনিবেশ করছি। তিনি চাকরি না করে কৃষিভিত্তিক উৎপাদনে অনেক উন্নতি করেছেন। তরনি কান্ত ও আনন্দ বর্মন নামে দুই শ্রমিক বলেন, আগে প্রতিদিন আমরা কাজ পেতাম না। একদিন কাজ করলে দুই-তিন দিন আমাদের বসে থাকতে হতো। এখন মেহেদী ভাইয়ের কৃষি খামারে প্রতিদিন কাজ করে আয় করছি প্রায় ২০ থেকে ২৫টি পরিবার। তার খামারে কাজ করা মোজাম্মেল হক বলেন, আমি মেহেদীর খামারে অনেক বছর ধরে কাজ করি। তিনি কৃষি করেই চাকরিজীবী থেকেও বেশি আয় করেন। তিনি এমন কিছু নেই যে, আবাদ করেন না। তার এমন সাফল্যে আমরা খুশি ও এখানে কাজ করে আমরাও ভালো আয় করছি। চাকরির সুযোগ পেয়েও দেশ ও মানুষের জন্য কিছু করার প্রত্যাশায় তিনি এমন উদ্যোগ বেছে নেন এবং চাকরি না করেও কৃষিতে তার থেকে ভালো আয় হয় বলে জানান, এই কৃষি উদ্যোক্তা এআইপি মো. মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী। মেহেদী আহসান বলেন, আমি সম্পূর্ণভাবে আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি অধিদপ্তরে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে শুধু ৫০ শতক জমিতে বিষম্ক্তু নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে সবজি আবাদ শুরু করি। এভাবে চাষ করে ফলাফল ভালো পাওয়ায় পর্যায় ক্রমে আমি সবজি চাষ বৃদ্ধি করতে থাকি। এখন আমি প্রায় ১২ একর জমিতে কীটনাশক মুক্ত বিভিন্ন সবজি আবাদ করি। এছাড়া আলু, ধান, গম, হলুদ, চাসহ বিভিন্ন প্রকার ফলের বাগান, পশুপাখির খামার ও মাছ চাষ করছি। প্রায় ৫০ একর জমিতে আমি কৃষি করি। মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা ও সবজি রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিশেষ ভূমিকা রাখায় উত্তর বঙ্গের মধ্যে শুধু আমি পুরষ্কৃত হয়ই ২০১৭ সালে। এছাড়াও কৃষিতে বিশেষ অবদান রাখায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক ২০১৮ সালে এবং কৃষিক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি (এআইপি) সম্মাননা ২০২০ সালে দেশে মোট ১৩ জনকে দেওয়া হয়। তার মধ্যে আমিও একজন। আর এই সম্মাননা প্রদান করা হয় ২০২২ সালে। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায়ে আমি জেলার শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছি। এসব পুরস্কার আমাকে কৃষিতে আরো অগ্রসর করে তুলছে প্রতিনিয়ত। এই কৃষি উদ্যোক্তা আেরা বলেন, জেলায় ব্যাপক সবজি উৎপাদন হলেও সংরক্ষণের অভাবে অনেক সময় কৃষকদের লোকসানে পড়তে হয়। তাই সরকারকে এখানে সবজি সংরক্ষণাগার স্থাপন করার অনুরোধ করছি। সংরক্ষণাগার স্থাপন করা হলে কৃষকরা আেরা অনেক উপকৃত হবেন বলে মনে করেন তিনি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, মেহেদী আহসান উল্লাহ চৌধুরী পড়াশোনা শেষ করে চাকরির পেছনে না ছুটে কৃষিতে অগ্রসর হয়েছেন। তিনি একজন আদর্শ কৃষক। তার উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। তিনি এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক ও এআইপি সম্মাননা পেয়েছেন। তিনি চাকরি করলে হয়তো সীমিত একটি আয় করতেন। কিন্তু বাণিজ্যিক কৃষি করে চাকরিজীবীর থেকেও বেশি আয় করার সুযোগ থাকে। মেহেদীর কৃষির মাধ্যমে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং তার দেখে অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন ও তার পরামর্শ নিয়ে কৃষি করছেন। এই অর্থে তিনি স্বাধীন ও তার সৃষ্টিশীল কাজ করার সুযোগ রয়েছে বলে মনে করি আমি। তিনি আরো বলেন, আমরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তাকে বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতা ও পরামর্শ প্রদান করে যাচ্ছি। আমরা যারা সরকারিভাবে কৃষিকে সম্প্রসারণের জন্য কাজ করছি। আমাদের মতো তিনিও একজন মাধ্যম। তার আরো সাফল্য কামনা করেন তিনি।