গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে ২০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে টানা আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। তবে ফিলিস্তিনের আরেক অংশ অধিকৃত পশ্চিম তীরেও থেমে নেই ইসরায়েলের বর্বরতা। সেখানে অভিযানের নামে প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছে ইসরায়েলি বাহিনী। এই পরিস্থিতিতে ইসরায়েলকে পশ্চিম তীরে ‘বেআইনি হত্যাকাণ্ড’ বন্ধ করতে বলেছে জাতিসংঘ। গতকাল এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ‘বেআইনি হত্যা’ এবং বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। একইসঙ্গে ইসরায়েলি অভিযানের সময় এই অঞ্চলে মানবাধিকার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হওয়ার বিষয়েও সতর্কবার্তা দিয়েছে সংস্থাটি।
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এক রিপোর্টে ঘনবসতিপূর্ণ শরণার্থী শিবিরে বিমান হামলা এবং সামরিক অনুপ্রবেশের ঘটনা ‘উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি’ পেয়েছে বলে এক রিপোর্টে বিস্তারিত প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয়। এই ধরনের হামলা ও অনুপ্রবেশের ফলে মৃত্যু, আহত এবং অধিকৃত অঞ্চলে বেসামরিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আইন প্রয়োগের প্রেক্ষাপটে সামরিক কৌশল এবং অস্ত্রের ব্যবহার, অপ্রয়োজনীয় বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তির ব্যবহার এবং ফিলিস্তিনিদের প্রভাবিত করে এমন যেকোনও বিস্তৃত, স্বেচ্ছাচারী এবং বৈষম্যমূলক বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
গত ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীর এবং অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। সেসময় থেকে পশ্চিম তীরে শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘ পশ্চিম তীরে অন্তত ৩০০ ফিলিস্তিনির মৃত্যুর বিষয়টি যাচাই করেছে, যার মধ্যে ৭৯ জন শিশুও রয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। নিহত এসব ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ২৯১ জন ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে, আটজন বসতি স্থাপনকারীদের হাতে এবং একজন সৈন্য বা বসতি স্থাপনকারীদের হাতে নিহত হয়েছেন।
এছাড়া গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে পশ্চিম তীরে প্রায় ৪ হাজার ৮০০ ফিলিস্তিনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। একইসঙ্গে গত ৭ অক্টোবর থেকে পশ্চিম তীরে ‘বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি’ পেয়েছে বলে জাতিসংঘ নথিভুক্ত করেছে। যার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে ‘গুলিবর্ষণ, বাড়িঘর ও যানবাহন পুড়িয়ে ফেলা এবং গাছ উপড়ে ফেলা’ মতো ঘটনাও রয়েছে।
ভলকার তুর্ক বলেন, ‘আমি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা বন্ধ করতে, বসতি স্থাপনকারীদের এবং ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সহিংসতার সমস্ত ঘটনা তদন্ত করতে, ফিলিস্তিনি সম্প্রদায়কে উচ্ছেদে যে কোনো ধরনের বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অবিলম্বে, স্পষ্ট এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
এর আগে ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরে সহিংসতা রোধে ইসরায়েলকে ফের তাগিদ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। চলতি ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে দেশটি বলেছে, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার বিষয়ে ইসরায়েলকে ‘আরও কিছু করতে হবে’। তারও আগে চলতি মাসেই পশ্চিম তীরে সহিংস ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ শুরু করার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। পরে যুক্তরাষ্ট্রের পথ ধরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা বিবেচনার কথা জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ)। এছাড়া ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতার জন্য দায়ী ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ব্রিটেনে প্রবেশ নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। ইইউ একই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্যামেরন ব্রিটেনের এই পরিকল্পনার কথা জানান।
জাতিসংঘের প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৭ অক্টোবর গাজা উপত্যকার ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর ইসরায়েল-অধিকৃত পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দৈনিক হামলার সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। হামাস-ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর আন্তঃসীমান্ত হামলা এবং গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধের দিকে যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মনোনিবেশ করেছে, তখন পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান সহিংসতার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ইউরোপীয় কর্মকর্তারাও।