সুসংবাদ প্রতিদিন
নওগাঁয় হাঁসের পালকের জমজমাট ব্যবসা
প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আব্বাস আলী, নওগাঁ
হাঁসের পালক সাধারণত বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেয়া হয়। তবে হাঁস-মুরগির পালক অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে বিবেচনা করে সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা ব্যবসায়ীদের হাত ধরে বছরে প্রায় দেড় কোটি টাকার পালক চলে যাচ্ছে রাজশাহী ও ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। তবে পুঁজি সংকটে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সরাসরি রপ্তানি করতে পারছেন না। রপ্তানি করা গেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্টরা। নওগাঁর রানীনগর উপজেলার বালুভরা গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন প্রয়াত মজিবর রহমান। তিনি ছিলেন একজন ব্যবসায়ী। হাঁস-মুরগি ব্যবসা করতেন। ভারতে হাঁস-মুরগি সরবরাহ করতেন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের পর নাহিদ ফেদার এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এরপর পাকিস্তান ও চীনে হাঁসের পালক রপ্তানি করেন ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। পালক থেকে ফেদার, কোট, লেপ ও তোশক তৈরি হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় এক ব্যবসায়ীর কাছে পালক বিক্রি শুরু করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি ব্যবসা থেকে সরে আসেন। সেই ব্যবসার হাল ধরেন ছেলে আব্দুস সালাম। রানীনগর বাজারে তার পালক ও স্টেশনারি দোকান রয়েছে। আব্দুস সালাম বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ১৯৭৯ সালে মাধ্যমিক ও ১৯৮৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক এবং ১৯৯৫ সালে ডিগ্রি পাস করেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। উচ্চ শিক্ষিত (বিএসসি) হওয়া সত্ত্বেও তিনি কোনো চাকরি না করে ব্যবসা করছেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি নিজেই জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র ও চায়নাতে হাঁসের পালক রপ্তানি করেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৯৫ সালে মজিবর রহমান মারা যান। একই বছর সারা দেশের মতো জেলাজুড়ে ভয়াবহ বন্যা হলে রপ্তানির জন্য রাখা পালকগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রায় ১০ লক্ষাধিক টাকার মতো ক্ষতিগ্রস্ত হন আব্দুস সালাম।
ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বাড়তে থাকে দূরত্ব। তারপর থেকে অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে আর রপ্তানি করেননি তিনি। আবারও ঢাকার পুরোনো ব্যবসায়ীর (অনামিকা এন্টারপ্রাইজ) কাছে পালক বিক্রি করা শুরু আব্দুস সালাম। তবে ২০১৯ সালে বৈশিক মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হলে ব্যবসায়ীরা পালক না কেনায় আবারো প্রায় ৯ লাখ টাকার মতো ক্ষতিগ্রস্ত হোন। এতে হতাশ হয়ে পড়লেও হাল ছাড়েননি তিনি। রাজশাহীতে চায়না ব্যবসায়ীরা পালক কেনা শুরু করলে তাদের সাথে ব্যবসা শুরু করেন। তার দোকানে পাঁচজন শ্রমিকের কর্ম সংসংস্থান হয়েছে, যারা খারাপ ও ভালো পালক এবং আবর্জনা বাছাইয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। পালক ব্যবসায়ী আব্দুস সালাম বলেন, পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া পালক ব্যবসা। হকাররা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে পালক সংগ্রহ করে দিন শেষে তারা বিক্রি করে। এসব পালক ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি দরে কি না, হয়। পাইকারিতে বিক্রি করা হয় ১৮০ টাকা কেজি হিসেবে।
প্রতি সপ্তাহে প্রায় এক টন পালক সংগ্রহ হয়, যার বাজার মূল্য প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা। মাসে প্রায় ৭ লক্ষাধিক টাকার পালক বিক্রি হয়। তবে পুঁজি সংকটের কারণে আর রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই দফায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম।
তবে এখন ঋণ নাই। এসব পালক দিয়ে বিদেশে ফেদার, কোট, লেপ ও তোশক তৈরি হয়। তবে পালক বাছাইয়ে প্রয়োজন আধুনিক বাছাই মেশিন, যার দাম প্রায় অর্ধকোটি টাকা। এ মেশিন কি না সম্ভব হলে পালক বাছাই করে আরো ভালো দাম পাওয়া সম্ভব। পালক যদি রপ্তানি করা সম্ভব হয়, তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যবসার পরিধি বাড়ানোসহ অনেকের কর্মসংস্থান হবে। তার দোকানে পাঁচজন শ্রমিকের কর্মসংসংস্থান হয়েছে, যারা খারাপ ও ভালো পালক এবং আবর্জনা বাছাইয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কারখানার কর্মচারী আলতাফ হোসেন বলেন, ১৯৯৪ সাল থেকে এখানে কাজ করছি। ওই সময় মাসে পারিশ্রমিক পেতাম ৯০০ টাকা। বর্তমানে মাসে পারিশ্রমিক পাই ৯ হাজার টাকা।
ভালো-খারাপ পালক বাছাই ও আবর্জনা পরিষ্কার করে বস্তায় প্যাকেট করা আমাদের কাজ। উপজেলার পশ্চিম গোবিন্দপুর গ্রামের পালক সংগ্রহকারী মুনছের আলী বলেন, গত প্রায় ৩০ বছর ধরে বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে পালক সংগ্রহ করা হচ্ছে। সকালে বাড়ি থেকে বের হয় সারাদিনে যা সংগ্রহ হয়, বিকালে তা বিক্রি করা হয়। একটি পাতি হাঁসের পালক ৩ থেকে ৫ টাকা এবং রাজ হাঁসের পালক ১০ টাকা দিয়ে সংগ্রহ করা হয়। প্রতি কেজি পালক ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা হিসেবে বিক্রি হয়। দিনে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হয়। আগে ২০০ টাকা কেজি ছিল।
এখন দাম কমে যাওয়ায় আয়ও কমেছে। শীত মৌসুমে মানুষ বেশি হাঁস খায় এবং পালকও বেশি সংগ্রহ হয়। রানীনগর বাজার বণিক সমিতির সভাপতি কাজী রবিউল ইসলাম বলেন, আমরা দেখেছি দীর্ঘদিন থেকে আব্দুস সালাম পালকের ব্যবসা করে আসছেন। এ ব্যবসা তার বাবাও করেছেন। বাজারে আরো কয়েকটি পালকের দোকান আছে। অর্থ সংকটে আব্দুস সালাম পালক রপ্তানি করতে পারছেন না। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাসহ সব ধরণের সহযোগিতা করা হলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
উপজেলার রেলগেটের পাশে আরেক পালক ব্যবসায়ী মিরাজুল ইসলাম বলেন, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে পালকের ব্যবসা করছি। প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৩০০ কেজির মতো পালক সংগ্রহ হয়। এসব পালক ঢাকা ও রাজশাহীর ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করা হয়। এটি লাভজনক ব্যবসা বলে মনে হয়েছে। মানুষ এখন পালক ফেলে না দিয়ে হকারদের কাছে বিক্রি করে। তাদের হাত ধরে আমাদের মতো ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে। নওগাঁ বিসিক শিল্প নগরী উপব্যবস্থাপক শামীম আক্তার মামুন বলেন, হাঁসের পালক রপ্তানিযোগ্য একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এসব পালক থেকে বিভিন্ন বস্ত্র উৎপাদন করলে ব্যবসায়ীরা আরো লাভবান হবেন। তবে ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন। আর এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন বিসিকের এ কর্মকর্তা।