কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে ভিন্নধর্মী নৌকা স্কুল

* শিশুদের স্কুলে আসতে হয় না স্কুলই শিশুদের কাছে হাজির হয়

প্রকাশ : ০২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  মো. আমিনুল হক, কিশোরগঞ্জ থেকে ফিরে

প্রায় ২ হাজার মানুষের বসবাস কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার হামিদ পল্লী গ্রামে। কিন্তু এখানে নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অর্থাৎ স্কুল, মক্তব, মাদ্রাসা কোনোটাই নেই এখানে। বছরের প্রায় অর্ধেক সময় একটি দ্বীপের মতো জলবেষ্টিত থাকে এই গ্রাম। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম নৌকা। যেখানে জীবিকার উপার্জনই অনেকটাই দুঃসাধ্য ব্যাপার, সেখানে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য নৌকায় করে এই প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেকটা মূল ভূখণ্ডে অবস্থিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিশুদের লেখাপড়া করানোর কথা চিন্তায়ও আসে না। এ প্রেক্ষিতে ভিন্নধর্মী আয়োজন ‘হামিদ পল্লী নৌকা স্কুল’ গ্রামের শিশুদের অক্ষরজ্ঞান করে তোলা, পড়াশোনায় আগ্রহী করে তোলা এবং পরবর্তীতে মূলধারায় পড়ালেখার সাথে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে।

সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, DAM-UK এর সহায়তায় READ FOUNDATION, UK এর অর্থায়নে ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন Innovative Wetland Education Provision (IWEP) নামে একটি ইনোভেটিভ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটির আওতায় কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার ৪২০ শিক্ষার্থী নিয়ে দুটি ভাসমান নৌকা স্কুল ও ১০টি হাটিভিত্তিক চিলড্রেন লার্নি সেন্টার (সিএলসি) বা শিশু শিখন কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে প্রকল্পটির মূল ইনোভেশন, এর দুটি ভাসমান নৌকা। এ স্কুল দুটির ইনোভেটিভ অ্যাপ্রোচ স্থানীয় প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা বিবেচনাকে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে সংগ্রহ করা, স্কুল ছুটির পর পুনরায় ওইসব শিক্ষার্থীদের যথাস্থানে পৌঁছে দেয়া তার দায়িত্ব। এভাবে দ্বিতীয় শিফটের জন্যও তিনি একই কাজ করেন। প্রতিটি নৌকায় শিক্ষার্থীদের দেখভালো করা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষিকার পাশাপাশি একজন নারী কেয়ারগিভার বা যত্মপ্রদানকারী থাকেন।

যিনি সার্বক্ষণিক শিক্ষার্থীদের প্রতি যে কোনো ধরনের অসঙ্গত আচরণ বা ঝুঁকির প্রতি নজর রাখেন। প্রকল্পের শিখন কেন্দ্র শুরুর পূর্বেই মাঠ জরিপের মাধ্যমে শিশুদের শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষ, ভাসমান এবং হাটিভিত্তিক যাই হোক, স্কুলগুলোতে একটি স্বাগত এবং কার্যকর শিক্ষার ক্ষেত্র তৈরি করতে আকর্ষণীয়ভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। দৈনিক ৩ ঘণ্টা ও সাপ্তাহিক ছয় দিন ক্লাস পরিচালিত হয়। প্রকল্পের সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য মিঠামইন উপজেলার ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি ৫৮৮ জন বিদ্যালয়বহির্ভূত শিশুরা যাতে টেকসই ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করা।

এ ব্যাপারে মিঠামইন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. এরশাদ মিয়া বলেছেন, নৌকা স্কুল ফলপ্রসু এখানে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার মান ভালো এবং তারা স্কুলে আসতেও বেশি আগ্রহী। হাওর অঞ্চলে আনুষ্ঠানিক স্কুলগুলোতে ড্রপ-আউট-এর সংখ্যা বেশি হলেও নৌকা স্কুলে ড্রপ-আউটের পরিমাণ অনেক কম। তাই এই এলাকায় উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে নৌকা স্কুল আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

মিঠামইন উপজেলা শিক্ষা অফিসার রুহুল আমিন বলেন, নৌকা স্কুলের শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট সৃজনশীল। শিখন-শিক্ষণ পদ্ধতি শিশুবান্ধব হওয়ায় যতটুকু সম্ভব আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে। এই এলাকার দরিদ্র পরিবারের শিক্ষা বঞ্চিত শিশুরা নৌকা স্কলের মাধ্যমে লেখাপড়া শিখতে পারছে। ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের শিক্ষা সেক্টরের যুগ্ম পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের শিক্ষা সেক্টর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষাসেবা প্রদানে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

ভবিষ্যতেও এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখবে। প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর এবিএম শাহাবুদ্দিন বলেন, এ প্রকল্পটিকে আমরা একটি সৃজনশীল প্রকল্প হিসেবে বিবেচনা করি। এর মূল কারণ হলো- স্থানীয় ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান বিবেচনা করে অর্থাৎ শিক্ষার্থীদের দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে এবং হাওর অঞ্চল হওয়ায় শিক্ষার্থীদের স্কুলে না এনে স্কুল শিক্ষার্থীদের দোরগোড়ায় বা তাদের অবস্থানের কাছাকাছি নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করাই এই প্রকল্পের বিশেষত্ব।

উল্লেখ্য, নৌকা স্কুলগুলো বিভিন্ন হাটি থেকে শিক্ষার্থীদের সংগ্রহ করে, নৌকাতেই ক্লাস পরিচালনা করে। শিশুদের নৌকা স্কুলে আসতে হয় না, স্কুলই তাদের কাছে চলে যায়। ফলে শিশুরা যেমন নিরাপদ থাকে, সব অভিভাবক নিরাপদ ও নিরাপত্তা বোধ করে ও নিশ্চিন্তে থাকতে পারে। প্রতিটি নৌকা স্কুলে একজন মাঝি সার্বক্ষণিক নৌকা পরিচালনা করেন। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হক সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক জহরলাল দাস বলেন, নৌকা স্কুলের বিশেষত্ব হলো বর্ষা মৌসুমে শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসে না বরং স্কুলই শিক্ষার্থীদের কাছে যায়। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি আগ্রহী হয়ে একটি আনন্দঘন পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ করে। তবে এই শিক্ষা পরিচালনা জন্য যথেষ্ট প্রশিক্ষণ প্রদান করা প্রয়োজন এবং সুদূর প্রসারী চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। প্রসঙ্গত, এই প্রকল্পে আর্থিক সহযোগিতাদানকারী ইউকে-ভিত্তিক সংগঠন ‘রীড ফাউন্ডেশন’ ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনকে দীর্ঘদিন বিভিন্ন বিশেষায়িত প্রকল্প যেমন পথশিশুদের জন্য ড্রপ-ইন-সেন্টারভিত্তিক সেবা প্রদানে সহযোগিতা, দরিদ্র মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ, শিক্ষাসেবা ইত্যাদি প্রকল্পে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। এ প্রকল্পগুলোর জন্য ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের সহযোগী সংগঠন ডাম-ইউকে মধ্যস্থতা করে থাকে।