পরিবেশ আইন অমান্য করে কয়েক বছর ধরে কক্সবাজার সদরের ঝিলংজার বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁধারে জোরপূর্বক কৃষিজমির উর্বর মাটি কেটে সরবরাহ করা হচ্ছে ইটভাটায়। এতে যেমন জমির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। বাঁধ দেওয়া হয়েছে খালে। সন্ধ্যা হতেই চলাচল শুরু করে মাটিভর্তি শতাধিক ট্রাক। চলে রাতভর। মাটিবাহী ট্রাকের প্রভাব পড়ছে সড়কগুলোতেও। মাটি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।
খবর পেয়ে ঝিলংজার ইউপি চেয়ারম্যান টিপু সুলতানের সহযোগিতায় গতকাল শনিবার ভোর রাতে অভিযান চালিয়ে ৪টি ডাম্পার ও একটি স্কাভেটর জব্দ করেছে উপজেলার প্রশাসন। এতে নেতৃত্বে দিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সম্রাট খীসা। অভিযানে অংশ নেয় সদর থানা পুলিশ। ইউএনও খীসা বলেন, কৃষি জমি রক্ষার স্বার্থে ভুক্তভোগীর অভিযোগে চেয়ারম্যান টিপু সুলতানের সহযোগিতায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় ৪টি ডাম্পার ও একটি স্কাভেটর জব্দ করা হয়েছে। এছাড়া সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে মাটি ব্যবসায়ীদের দেওয়া খালের বাঁধটিও কেটে দেওয়া হয়েছে। অবৈধভাবে কৃষি জমির মাটি কাটার বিরুদ্ধে এই অভিযান চলবে।
তিনি বলেন, অনুমতি ছাড়া কৃষি জমির মাটি কেটে নেওয়া অপরাধ। যদি কেউ কৃষি জমির মাটি কেটে নেয় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সদর উপজেলার ঝিলংজা ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের খামারপাড়া, মেহেরআলী, মাস্টারপাড়া, রামুর চাকমারকুলের শ্রীমুরা, কলঘর ভুতপাড়া এলাকার কৃষিজমিগুলো থেকে রাতের আঁধারে কাটা হচ্ছে মাটি। বছর দশেক ধরে চলছে এই ধরনের মাটিকাটা। সম্প্রতি তা বেড়েছে বহুগুণ।
মাটি খেকরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, জোরপূর্বক রাতের আঁধারে সবজি ক্ষেত ও আমন ধানের জমির মাটি কেটে পুকুর খনন করতেও দ্বিধা করছে না। আর এসব মাটি বিক্রি করা হচ্ছে ইটভাটায়। আবার অনেকে বাড়ির ভিটা তৈরির জন্য মাটি কিনে নিচ্ছেন। এতে দিন দিন আশঙ্কাজনকহারে বিলীন হতে শুরু করেছে কৃষিজমি। প্রশাসনের নীরবতার কারণে ভূমি আইন অমান্য করে অবাধে অবৈধভাবে ফসলি জমির মাটি বিক্রি করেই চলছে অসাধু মাটিখেকোরা। যেন দেখার কেউ নেই!
অভিযোগ রয়েছে, কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্তাবাবুরা মাসোয়ারা নিয়ে এ সুযোগ করে দিচ্ছে মাটি খেকোদের। গত কয়েক বছরে শত শত পাহাড় নিধন কিংবা কৃষি জমির মাটি কেটে জলাশয়ে পরিণত করা হলেও খুব বেশি আলোচনা না হলে জনবল সংকটের অজুহাতে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। এছাড়াও উপজেলা প্রশাসনের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অর্থের বিনিময়ে ‘ম্যানেজ’ করে ফসলি জমি ধ্বংস করে মাটি বিক্রির ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন মাটিখেকোরা। মাটিখেকোদের উৎপীড়নে দিশাহারা হয়ে উঠেছে ফসলি জমির মালিক ও কৃষি শ্রমিকরা। তবে মাটিখেকোদের পরামর্শে কোনো কোনো জমির মালিক জমিতে ফসল ফলানোর পরিবর্তে বিক্রি করছে নির্বোধ কৃষকরা।
ঝিলংজা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, ৯নং ওয়ার্ডের খামারপাড়া ও মেহেরআলী পাড়া এলাকা থেকে রাতের আঁধারে জোরপূর্বক কৃষি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে কৃষিজমি। এছাড়া পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। আর এই মাটি বহনকারি ডাম্পার চালাচলের কারণে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি করা গ্রামীণ সড়কগুলোর বারোটা বাজাচ্ছে।
কৃষকদের কান্নার শব্দে বাড়িতে থাকা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করে চেয়ারম্যান আরো বলেন, খামারপাড়া বিলের কৃষি ও খালের বাঁধ কেটে পুকুরে পরিণত করা হচ্ছে। কিছুদিন ধরে এমন ধ্বংসযজ্ঞ চলে আসলেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেননি। রাতের আঁধারে কয়েকজন কৃষকের আহাজারি শুনে ঘটনাস্থলে গিয়ে শত শত ডাম্পার দিয়ে মাটি কাটার মহোৎসব দেখতে পাই। এ সময় স্থানীয় মেম্বারসহ লোকজনের সহযোগিতায় ৪ ডাম্পার ও স্কাভেটর জব্দ করে ইউএনও স্যারের মাধ্যমে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। মাটি খেকোদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন এই জনপ্রতিনিধি।
কৃষি কর্মকর্তারা বলেন, ফসলি জমির উপরিভাগের ১০ থেকে ১২ ইঞ্চির মধ্যে মাটির জৈব উপাদান থাকে। সেই মাটি কাটা হলে জমির জৈব উপাদান চলে যায়। এতে জমির স্থায়ী ক্ষতি হয়। ফসলি জমির মাটি কাটা তাই বেআইনি।
ঝিলংজার খামারপাড়া, মেহেরআলীপাড়া, পিএমখালীর পাতলী ও রামুর চাকমারকুল এলাকায় সরেজমিন দেখা যায়, ওইসব এলাকার স্থানীয়দের বাড়ি ঘেঁষে ফসলি জমি থেকে প্রতিদিনই মাটি লুট করা হচ্ছে। মাটি ব্যবসায়ীরা স্কাভেটর দিয়ে কোথাও ২০ থেকে ৩০ ফুট গভীর গর্ত করে মাটি নিয়ে যাচ্ছে। এসব গর্তে পাশের কৃষিজমির মাটিও ভেঙে পড়ছে। কোনো কোনো জমির মালিক টাকার লোভে মাটি বিক্রি করলেও অধিকাংশ কৃষক বাধ্য হয়ে মাটি বিক্রি করছেন।
মাটি ব্যবসায়ীদের লুট থেকে বাদ যাচ্ছে না খাসজমি, খাল ও নদ-নদীর তীর। এসব মাটির শেষ ঠিকানা হচ্ছে ইটভাটা। গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেওয়ায় এরই মধ্যে শতাধিক একর কৃষিজমি জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। জমিগুলোয় বোরো ধান আর শর্ষে চাষ করা হতো। গভীর গর্ত করে মাটি কাটায় ওইসব জমিতে দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।
খামারপাড়া এলাকার একাধিক বাসিন্দা বলেন, ওই এলাকায় অন্তত ৪০ বিঘা জমির ওপর ধান চাষ ও বিভিন্ন সবজি লাগিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। রাতের আঁধারে এন আলম নামের এক ইটভাটা মালিক তার সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে কৃষিজমি থেকে স্কাভেটর দিয়ে গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে পাশের কৃষিজমির মাটি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। মাটিকাটা বন্ধ না করলে একসময় ওই এলাকা থেকে কৃষিজমি হারিয়ে যাবে বলে মনে করছেন বাসিন্দারা।
পাতলী এলাকার কয়েকজন কৃষক জানান, প্রতিদিন রাতে কোনো না কোনো কৃষিজমির মাটি চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। কৃষিজমির মাটি চুরির বিষয় নিয়ে আতঙ্কে রয়েছি আমরা। স্থানীয় প্রশাসনও তাদের কিছু বলে না। গতকাল শনিবার রাতে আমাদের জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পেয়ে চেয়ারম্যান টিপুকে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি এসে ৪টি ডাম্পার গাড়ি ও একটি ভেকু জব্দ করে ইউএনওর মাধ্যমে থানা পুলিশের জিম্মায় দিয়েছেন। কৃষিজমির মাটি লুটের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
নাম প্রকাশ না করে কয়েকজন মাটি ব্যবসায়ী বলেন, জমির মাটি কিনে নিয়ে আশপাশের ইটভাটামালিকদের কাছে বিক্রি করছি। এই এলাকার মাটি ইটভাটার জন্য খুবই উপযোগী মাটি। আর এই টাকা আমাদের পকেটে যায় না; পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রশাসনের লোকজনের পকেটেও যায়।