মৌসুমে প্রায় সাড়ে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এবারে মাঠে কক্সবাজার-চট্টগ্রামে মাঠে নেমেছেন প্রায় ৩৯ হাজার ৪৮৭ জন লবণ চাষি। গত অর্থবছরের মতোই লাভের স্বপ্ন নিয়ে ব্যাপক উদ্দিপনায় চাষিরা এবারে ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে চাষি করছেন। এরই মধ্যে অনেক চাষি নতুন মৌসুমের কয়েক চালান লবণ তুলেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে নির্ধারিত সময়েই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে, ভয়ও কাজ করছে চাষিদের। মৌসুমের ফাঁকে যদি কোনো কারণে লবণ আমদানি করা হয়, তখন উৎপাদিত লবণের ন্যায্য দাম না পাওয়ার সম্ভাবনায় বেশি। এমনটি হয়ে থাকলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের একমাত্র স্বয়ংসম্পূর্ণ খাত লবণ শিল্প।
সংশ্লিষ্টদের দাবি, একটি মধ্যস্বত্বভোগী সরকারের উচ্চ পর্যায়ে ভুল বুঝিয়ে লবণ আমদানির আয়োজন করতে পারে। অথচ জেলার সাত ও চট্টগ্রামের দুই উপজেলায় লবণ চাষে পুরোদমে মাঠে নেমেছে প্রান্তিক চাষিরা। গত ৩০ অক্টোবর চলতি লবণ মৌসুম শুরুর পর হতে বাঁশখালী ও কক্সবাজারের কুতুবদিয়া এবং অন্যান্য এলাকায় কয়েক হাজার মেট্রিন টন লবণ এরই মধ্যে উৎপাদন হয়েছে।
জানা গেছে, ধানকাটা শেষ হওয়ার পর পরই লবণ চাষে নামার কার্যক্রম শুরু হয়। গত মৌসুমে লবণের ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় এবারো আশা নিয়ে মাঠে নেমেছেন হাজারো চাষি। শ্রমিক ও প্রয়োজনীয় আনুষঙ্গিক সামগ্রীসহ মাঠে গিয়ে ধর্মীয় নীতি মেনে লবণ চাষের কাজ উদ্বোধন করেন। মৌসুমের শুরুতে প্রথম লবণ উৎপাদন হয় বাঁশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলায়। পলিথিনে উৎপাদিত লবণ বিক্রি হয়েছে ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়।
কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডী ও ঈদগাঁওর পোকখালী এবং গোমাতলীতে গিয়ে দেখা গেছে, চাষিরা মনোযোগী হয়ে মাঠে কাজ করছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চাষিরা আনন্দে লবণ উৎপাদনে সময় ব্যয় করছেন।
অনেক চাষি ও ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, দেশে লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্র কক্সবাজার জেলা ও বাঁশখালী। এখানকার উৎপাদিত লবণ নিয়ে সারাদেশের মানুষ খাওয়ার পর বিদেশেও রপ্তানি করা যায়। কিন্তু সরকারকে একশ্রেণির দালালচক্র ভুল বুঝিয়ে লবণ আমদানি করে দেশীয় লবণের ক্ষতি করছে।
গোমাতলীর লবণচাষি আবদুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, ঈদগাঁওর পোকখালী, গোমাতলী, মহেশখালীর প্রায় প্রতিটি ইউনিয়ন, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফসহ উপকূলীয় এলাকায় লবণ চাষিরা পুরোদমে মাঠে নেমেছে। যেকোন মূল্যে দেশের চাহিদা মতো লবণ উৎপাদনই আমাদের লক্ষ্য। তবে, সরকারের কাছে দাবি- কোনো চক্র যেন বিদেশি লবণ আমদানি করতে না পারে।
চৌফলদন্ডীর জিয়াবুল হক বলেন, একজন শ্রমিক এক একর জমি চাষি করতে পারে। চলতি মৌসুমে একর প্রতি জমি লীজ নিতে হয়েছে ৭৫ হাজার টাকায়। পুরো মৌসুমে একজন শ্রমিকের মূল্য ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। মৌসুম শেষ করা পর্যন্ত খাবার, পলিথিন মিলিয়ে খরচ হবে এক লাখ টাকা। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে একরে ৭৫০ মণ লবণ উৎপাদন সম্ভব। শুরু হতে মৌসুম শেষ পর্যন্ত গড়ে ৫০০ টাকায় লবণ বিক্রি সম্ভব হলে একরে উৎপাদিত লবণে আয় হবে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। আর কোনো কারণে লবণ উৎপাদন হলে দেশি লবণের দাম পড়ে গেলে সকল লবণ চাষিকে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হবে। লবণই একমাত্র পণ্য যা দেশে চাহিদা মেটানোর পরিমাণ উৎপাদন হয়। তাই কেউ মিথ্যে তথ্যে যেন বিদেশ থেকে লবণ আমদানির সুযোগ না পায়, তা নিশ্চিত করতে বাণিজ্য ও প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি তৃণমূল চাষিরা।
বিসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩-২০২৪ মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদা রয়েছে ২৫ দশমিক ২৮ লাখ মেট্রিক টন। ২০২৩-২০২৪ মৌসুম শুরুতে মাঠ পর্যায়ে লবণ মজুদ ছিল ১ দশমিক ৬০ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২-২০২৩ মৌসুমে দেশে লবণের চাহিদা ছিল ২৩ দশমিক ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। এ মৌসুমে লবণ উৎপাদন হয় ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন। ২০২১-২০২২ মৌসুমেও উদ্ধৃত উৎপাদন ছিল। এ মৌসুম ও গত মৌসুমে জমির পরিমান ছিল ৬৩ হাজার ২৯১ একর। ২০২৩-২৪ মৌসুমে লবণের মূল্য নির্ধারণ হয়েছে মণ ৫২৬ টাকা। বিসিকের বৃহৎ লবণ কেন্দ্র রয়েছে-কুতুবদিয়ার লেমশি খালী, উত্তর নলবিলা, মহেশখালীর গোরকঘাটা, মাতারবাড়ি, ঈদগাঁওর গোমাতলী, সদরের চৌফলদন্ডী, পেকুয়ার দরবেশকাটা, চকরিয়ার ডুলাহাজারা ও ফুলছড়ি, টেকনাফ, বাঁশখালীর পুর্ব বড়ঘোনায়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিসিক) লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয় কক্সবাজারের পরিদর্শক (উন্নয়ন) মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী জানান, নভেম্বর মাসের শুরুতে বর্ষার ধানের চাষি উঠে যায়। এরপর লবণের মাঠ তৈরিতে নামে লবণ চাষিরা। মৌসুম চলাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টি না হলে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে লবণ চাষিরা বেশ উপকৃত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। গত বছর লবণের ন্যায্যমূল্য পেয়ে প্রান্তিক চাষিরা ফুরফুরে মেজাজে মাঠে নেমেছে। গত বছরের চেয়ে চলতি বছর লবণের গড়মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫২৬ টাকা।