ঢাকা ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রাধান্য দিয়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

* ‘সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী’ মুদ্রানীতি * রেপোর সুদ হার বাড়িয়ে ৮ শতাংশ
মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রাধান্য দিয়ে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

আবারও নীতি সুদহার বাড়াল বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নীতি সুদ হার বা রেপো রেট ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে নীতি সুদহার বাড়ানো হয়েছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মেলন কক্ষে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২য় ষান্মাসিক (জানুয়ারি-জুন, ২০২৪) মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। এরপর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। এ সময় তিনি বলেন : ডিসেম্বরের মধ্যে ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পারিনি। কারণ অনেক তবে সেটা না বলে বরং চেষ্টা করছি অতি দ্রুত যাতে জুনের মধ্যে এটা কমিয়ে ৬ শতাংশ এর মধ্যে নামানো যায়।

রেপো রেট বেড়ে যাওয়ায় ঋণ নেওয়া আগের চেয়ে ব্যয়বহুল হবে। প্রসঙ্গত, অর্থনীতির ভাষায় ক্রলিং পেগ হলো নিজের দেশের মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার সমন্বয়ের একটি পদ্ধতি; যেখানে একটি নির্দিষ্ট বিনিময় হারসহ একটি মুদ্রাকে একটি সীমার মধ্যে ওঠানামা করার অনুমতি দেয়া হয়। নীতি সুদহার বৃদ্ধির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণের সুদহার বাড়বে। এ পরিস্থিতিতে সাধারণত ঋণের চাহিদা কমে যায়। এর মধ্য দিয়ে অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ কমে গেলে মূল্যস্ফীতির সূচক মাথা নামাতে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা। সে কাজের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হচ্ছে নীতি সুদহার বাড়ানো বা কমানো। মুদ্রানীতি হলো একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা রক্ষার জন্য দেশের আর্থিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গৃহীত নীতি। যা দেশের অর্থনীতিতে অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত ও নিয়ন্ত্রণ করে। মুদ্রানীতি দেশের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে সুদের হার এবং অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে। একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান আর্থিক কর্তৃপক্ষ হিসেবে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। দেশের সরকারের পক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতি প্রণয়ন ও পরিচালনা করে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সামস্টিক, অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে এবং বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক অবস্থা অনুমান করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে থাকে। ‘সতর্ক ও সঙ্কুলানমুখী’ মুদ্রানীতিতে রেপোর সুদ হার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে এ ৮ শতাংশ করা হয়েছে। চলমান অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণের কৌশলকে প্রাধান্য দিয়ে পাঁচ চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই এই নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মুদ্রানীতিতে পাঁচটি নিকট-মেয়াদি সামস্টিক অর্থনৈতিক সমস্যা এবং চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো- মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার মধ্যে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দামের গতিশীলতা। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। মুদ্রাস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে হ্রাস করা। বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা। অপারফর্মিং ঋণের স্থায়ী সমস্যা।

এবারের মুদ্রানীতিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের মধ্যে ধরে রাখার লক্ষ্য নিয়ে মুদ্রানীতি তৈরি করা হয়েছে। আগামী জুন পর্যন্ত মূল্যস্ফীতি ৭.৫ শতাংশ, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৫ শতাংশ ধরা হয়েছে। তবে বছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে থাকবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

গভর্নর বলেন, এবারের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি প্রশমন করা। মুদ্রানীতির প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে অনেক সময় লেগে যায়। এতে মূল্যস্ফীতি কমতে সময় লেগেছে। তবে নভেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে। নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, এখন থেকে এ হার হবে ৮ শতাংশ। এছাড়া বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ৩১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৭.৮ শতাংশ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বছরে দুইবার মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষার চেষ্টা করে থাকে। চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মুদ্রানীতি এটা। এর আগে গত জুলাইয়ে প্রথম দফা মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

মুদ্রানীতি ঘোষণার পর গভর্নর বলেন, মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে। এবারের মুদ্রানীতিতে ৪টি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে মনিটরিং পলিসি করা হয়েছে। সরকারের নির্বাচনি ইশতেহারের সঙ্গে এই মুদ্রানীতি সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়া মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রবৃদ্ধি ১ শতাংশ কমলে অসুবিধা নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

নিজের কাজে কোনো ধরনের চাপ অনুভব করছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুর রউফ তালুকদার বলেন, আমি কাউকে ভয় পাই না, স্বেচ্ছায় অর্থ সচিবের চাকরি ছেড়ে চুক্তিতে গভর্নরের দায়িত্ব নিয়েছি, কাজেই কোনো চাপ বা অন্য কিছুর ভয় দেখিয়ে আমাদের দিয়ে কিছু করিয়ে নেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে কোনো ব্যাংক বন্ধের সম্ভবনা উঠিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ৫২ বছরে দেশে কোনো ব্যাংক বন্ধ হয়নি, আগামীতেও হবে না। তবে দুর্বল ব্যাংক চিহ্নিত করে একীভূত করার পরিকল্পনা আছে। ব্যাংকিং খাতে গ্রাহকদের আস্থার কোনো সংকট নেই বলে এ সময় মন্তব্য করেন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। নতুন মুদ্রানীতিতে বিদেশি মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ‘ক্রলিং পেগ’ পদ্ধতি ব্যবহারের চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। তবে এ পদ্ধতিতে ডলারের বিনিময় হার কত হবে, তা বলা হয়নি। পরে তা জানানো হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়।

উচ্চ মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক গত ১ বছরে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরামর্শে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আইএমএফের ঋণের শর্তানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম মুদ্রানীতিতে নীতি সুদহারের করিডর প্রথা চালু, সুদহারের সীমা প্রত্যাহার, ডলারের একক দাম, রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়নসহ নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি রোধে মুদ্রা সরবরাহনির্ভর নীতি থেকে সরে এসে সুদহার লক্ষ্য করে মুদ্রানীতি প্রণয়ন শুরুর ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরবৃন্দ, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তা, চিফ ইকোনোমিস্ট, গবেষণা বিভাগের নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও সহকারী মুখপাত্ররা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত