কক্সবাজার শহরের কাছাকাছি এলাকা সমিতি পাড়া এলাকায় বালিয়াড়ি দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে শত শত বসতি। অবৈধভাবে শত শত বসতি গড়ে উঠলেও স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগের টনক নড়ে না। দখলবাজ চক্রের দখল পাকাপোক্ত হওয়ার পর ঘুম ভাঙে প্রশাসন ও বন বিভাগের। গতকাল সকালে কক্সবাজারের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামীর নেতৃত্বে ওই এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হয়। এ সময় সৈকতের বালিয়াড়িজুড়ে অসংখ্য স্থাপনার মধ্যে কয়েকটি স্থাপনা ভাঙা হয়। এছাড়াও মাছের প্রজেক্টের সীমানা বেড়া ভাঙা হয়েছে কয়েকটি। তবে বেশিরভাগ স্থাপনা থেকে গেছে এখনো। স্থানীয়দের অভিযোগ, সমিতি পাড়া এলাকায় বালিয়াড়িতে কিছু সংখ্যক বসতি উচ্ছেদ করে দায় সারলেন প্রশাসন।
অভিযানে নেতৃত্বদানকারী সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নিজামী সাংবাদিকদের বলেন, সরকারি খাস জায়গায় নির্মাণ করা সব স্থাপনা আমরা ধীরে ধীরে উচ্ছেদ করব। যেহেতু এটি সরকারি খাস জমি সেহেতু এই জায়গা আমরা উদ্ধারে কাজ করে যাব।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে ছোট-বড় স্থাপনার পাশাপাশি পেয়ারা বাগান, ইউক্যালিপটাস গাছের বাগান, মাছের প্রজেক্ট করা হয়েছে। উচ্ছেদ অভিযানে ঘেরা বেড়া ভাঙা হলেও স্থাপনা থেকে গেছে বালিয়াড়িজুড়ে। অনেকেই বলেছেন উচ্ছেদ অভিযানে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন তারা। দেখে দেখে স্থাপনা ভাঙা হয়েছে। বিশাল বালিয়াড়িজুড়ে এখনো অসংখ্য স্থাপনা বিদ্যমান। বেশিরভাগ স্থাপনা উচ্ছেদ না হলেও স্কুল এবং খেলার মাঠের দুটি ভিত্তি প্রস্তরযুক্ত নাম ফলক ভেঙে ফেলা হয়েছে।
সূত্র মতে, প্রতিযোগিতা করে সমুদ্রসৈকত দখলে নেমেছে একটি প্রভাবশালী চক্র। দখলের পর তা প্লট বানিয়ে স্ট্যাম্পের মাধ্যমে সমুদ্রসৈকত বিক্রি করেছে কোটি কোটি টাকায়। শুধু সমিতি পাড়া এলাকায় হাজার হাজার একর সৈকত দখল করে সেখানে শত শত বসতি গড়ে তুলেছে চক্রটি। দখলবাজদের কেউ কেউ আবার নিজের নামে পাড়ার নামকরণ করে বসতি গড়ে তুলছেন।
অভিযোগ আছে, কক্সবাজার পৌরসভার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, জামায়াত ও বিএনপি নেতাদের নেতৃত্বে ভূমিদস্যু চক্রটি গড়ে উঠেছে। নাম শোনা যাচ্ছে একজন প্রভাবশালী সচিবসহ কয়েকজন আইনজীবীরও। তাদের সঙ্গে মিলেমিশে স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তারা সমুদ্রসৈকত দখল করে ঝাউবন কেটে প্লট বানিয়ে বিক্রি করছেন দীর্ঘদিন ধরে। অভিযুক্তদের দাবি, অন্যের কাছ থেকে একই কায়দায় দখল কিনে তারাও স্ট্যাম্পে সুমদ্র বিক্রি করছেন।
পরিবেশবিদরা বলছেন, বাতাসবিরোধী অসম্ভব ক্ষমতার জন্য সমুদ্রসৈকতে ঝাউগাছ লাগানো হয়। ঝাউগাছ ঝড়ের গতিকে প্রতিরোধ করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা রাখে। জলোচ্ছ্বাসের সময় এ গাছ মানুষের আশ্রয় হিসাবেও কাজ করতে পারে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের সমুদ্রসৈকতের ঝাউবন কেটে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বানানো হয়েছে কয়েকশ’ একর প্লট। আবার সেই প্লট ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে ভূমিহীন, রোহিঙ্গা ও বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দাদের কাছে। সেখানে তারা নির্মাণ করেছে শতাধিক ঘরবাড়ি। কয়েকটি স্থানের ঝাউবন ধ্বংস করে পুকুর বানিয়ে করা হয়েছে মাছের চাষ। এমনকি প্রভাবশালীরা সমুদ্রসৈকতে কয়েকটি এলাকার নামকরণ করেছেন তাদের নিজেদের নামে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, এই প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের সাথে ভূমি অফিস ও বন বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কর্মচারী জড়িত রয়েছে। প্রভাবশালীরা এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে সমুদ্রসৈকত দখল করে গ্রাম বানাচ্ছেন। যার কারণে প্রকাশ্যে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সমুদ্রসৈকত দখল করে বিক্রি করলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না প্রশাসন। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো অভিযান পরিচালনা করে কয়েকটি স্থাপনা ভেঙে দেওয়া হলেও জড়িতরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা বা এই দখলবাজির মহোৎসব বন্ধ করা হচ্ছে না বলে জানান স্থানীয়রা।
সমুদ্রসৈকতের বালিয়াড়ি দখলে পিছিয়ে নেই পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা আক্তার কামাল আজাদ। তিনিও সৈকতের বালিয়াড়ি দখল করে ঝাউবাগান কেটে ম্যালেরিয়া গাছের বাগান করে রেখেছেন কয়েক বছর ধরে। সেখান থেকে আবার লিংক রোডের এক ব্যক্তিকে প্লট বানিয়ে ১ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন তিনি। এছাড়াও কয়েকশ’ একর খাস জমি তার দখলে রয়েছে বলে জানান স্থানীয়রা।
এদিকে ঝাউবাগান রক্ষার জন্য ৩০ জনের কমিটি করেছিল বন বিভাগ। অভিযোগ আছে, এই কমিটির বেশিরভাগ সদস্য সমুদ্রসৈকত রক্ষার ঝাউবাগানকে নিজের সম্পত্তি মনে করে প্লট বানিয়ে গন্ডা হিসেবে চড়া দামে রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন জেলার বাসিন্দাদের কাছে বিক্রি করেছেন তারা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, সমুদ্রসৈকতের সীমানা নির্ধারণ করার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে যাচ্ছি। কিন্তু সমুদ্রসৈকত রক্ষার জন্য আজ পর্যন্ত কোনো কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করা হয়নি। যার কারণে ঝাউবাগান কাটা হলেও ব্যবস্থা নেয় না প্রশাসন। এভাবে নির্বিচারে ঝাউবন কেটে প্লট বানিয়ে বিক্রি করার ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। ঝাউবন রক্ষায় বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে বলে জানান পরিবেশের এই নেতা। স্থানীয় কাউন্সিলর ও বিএনপি নেতা আকতার কামালের কাছে সুমদ্র দখলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেন।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারওয়ার আলম বলেন, সরেজমিন গিয়ে অভিযুক্তদের চিহ্নিত করা হয়েছে। গত বুধবার সকালে প্রশাসনের সমন্বয়ে অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে পরিচালনা করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, সমুদ্রসৈকতের ঝাউবন কেটে প্লট বানিয়ে বিক্রি করার কোনো নিয়ম নেই। এই রকম অভিযোগ জানতে পেরে অভিযান শুরু করা হয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।