ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে চঞ্চল হতে শুরু করে শরীয়তপুরের জাজিরার মিরাশার চাষিবাজার। বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকারদের ভিড়। কৃষক তাদের জমি থেকে পেঁয়াজ উঠানোর পর ভ্যান কিংবা নসিমনবোঝাই করে নিয়ে আসেন বাজারে। আর এসব পেঁয়াজ পাইকারদের মাধ্যমে চলে যায় দেশের বিভিন্ন জায়গায়। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন এই বাজারে বিক্রি হয় প্রায় ৩ কোটি টাকার পেঁয়াজ। চাষিবাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির তথ্য অনুযায়ী, বাজারটি কমপক্ষে ৮ বছরের পুরোনো। এখানে মৌসুমে পেঁয়াজের সরবরাহ বেশি হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারদের পছন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাজারটি। এছাড়াও কোনো প্রকার খাজনা দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনা এখানে। তুলনামূলক সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রয় করত পারায় এ বাজারে আগ্রহ বাড়ছে পাইকার ও ব্যবসায়ীদের। পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে ঢাকা অঞ্চলের পাইকারদের প্রথম পছন্দ এ বাজারটি। জানা যায়, প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই বাজারে পেঁয়াজ আসতে শুরু করে। এ বছরও ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পেঁয়াজ নিয়ে আসছেন কৃষকরা। প্রথম দিকের অপরিপক্ক পেঁয়াজগুলো প্রতি কেজি ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। তবে পেঁয়াজ সরবরাহ বাড়ার পর থেকে দামও কিছুটা পড়ে যায়। বর্তমানে মানভেদে কেজি প্রতি ৬৫ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রি করা হচ্ছে। ভরা মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টন পেঁয়াজ বিক্রি হয় এই বাজারে। চলতি মৌসুম মিরাশার চাষি বাজারে অন্তত ২৫০ কোটি টাকার পেঁয়াজ বিক্রি হতে পারে। একদিকে পদ্মা সেতুর সুফল, আর অন্যদিকে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাওয়ায় দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বাজারটি। পাশাপাশি প্রায় তিন শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিকের কর্মসংস্থানও হয়েছে বাজারের মাধ্যমে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকেই কৃষকরা যানবাহনে করে তাদের উৎপাদিত পেঁয়াজ বাজারে নিয়ে আসছেন। বাজারে আসা পেঁয়াজের বস্তাগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। পাইকাররা এসে কৃষকের কাছ থেকে দামদর করে পেঁয়াজ কিনে টাকা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এসব বস্তা আবার শ্রমিকের মাধ্যমে ঢেলে ছোট পেঁয়াজ বাছাই ও পরিষ্কার করে অন্য বস্তায় ভর্তি করছেন। মিরাশার চাষি বাজারের ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম। তিনি পাঁচ বছর ধরে এই বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। তিনি বলেন, জাজিরার মিরাশার চাষি বাজারটি দক্ষিণ অঞ্চলের মধ্যে বড় কাঁচামালের বাজার। এখানে প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকার পেঁয়াজ বিক্রি করা হয়। বাজারটি মূলত গৃহস্থের বাজার, তারা নিজেরা মালামাল নিয়ে আসেন এবং পাইকারদের কাছে বিক্রি করে দেন। এখানে দক্ষিণ অঞ্চলের সব জেলার পাশাপাশি ঢাকা, ফেনি ও দেশের অন্যান্য জেলা থেকে পাইকারা পেঁয়াজ কিনতে আসেন।
নাওডোবা এলাকার পেঁয়াজ চাষি হাসেম বেপারী বলেন, আমি এই বাজারে সাত বছর পেঁয়াজ বিক্রি করি। এবছর চার একর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছি। ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ ওঠাই আর বাজারে ভ্যান ভরে নিয়ে আসি। পাইকারে আসেন দাম দর করেন দামে মিললে দিয়ে দিই। তারাও আমাদের হাতে হাতে টাকাগুলো দিয়ে দেয়। কোনো ঝামেলা ফ্যাসাদের প্রয়োজন পড়ে না। মূলনা এলাকার পেঁয়াজ চাষি রোমান বলেন, আমরা আশপাশের যত চাষিরা আছি মিরাশার চাষি বাজারে পেঁয়াজ বেচি। দক্ষিণাঞ্চলের বড় পেঁয়াজের হাট এটা। অনেক জায়গা থেকে পাইকাররা আসেন। কয়েকবছর ধরে পেঁয়াজের দাম ভালো পাওয়ায় আমরাও খুশি। এ বছর আমি এক বিঘা পেঁয়াজের জমি করেছি। আজ হাটে চার বস্তা পেয়াঁজ ৬০ টাকা কেজিতে বিক্রি করলাম।
বাজারে আসা পেঁয়াজ বাছাই করে বস্তাবন্দির কাজ করেন রত্না রানী। এখান থেকে প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৬০০ টাকা আয় করেন। এই বাড়তি আয় দিয়ে তার চার সদস্যের পরিবারের কিছুটা অভাব ঘুচেছে। তিনি বলেন, আমার মতো এখানে আরও ১০০ নারী শ্রমিক কাজ করে। আমরা পেঁয়াজগুলো বাছাই করে নতুন বস্তায় ভরি। এখান থেকে যেই টাকা পাই তা দিয়ে আমাদের পরিবারগুলোর বেশ ভালোই যায়। আমার মতো গরিব নারীদের জন্য এই বাজার আশীর্বাদের মতো। ফেনী থেকে পেঁয়াজ কিনতে আসা মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের এক পাইকার বলেন, আমি ফেনী থেকে ৩ বছর ধরে এখানে পেঁয়াজ কিনতে আসি। ফেনীতে আমার তিনটি মোকাম আছে। এখান থেকে পেঁয়াজ কিনে মোকামের মাধ্যমে আমি আমার জেলার বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করি। সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ কিনতে পারায় আমরা পাইকাররাও অনেক খুশি। বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আব্দুল জলিল মাদবর বলেন, সমবায় ভিত্তিক এই বাজার কৃষক আর পাইকাইদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ। কৃষক আর পাইকাররা নিজেদের মধ্যে দামদর করে পণ্য বেচাকেনা করে থাকেন। কোনো মধ্যসত্ত্বভোগী এই বাজারে নেই। তাই প্রতি বছর বাজারের পরিধি বেড়ে চলেছে।