ঢাকার সাভারের ইয়ারপুর, আশুলিয়া এবং ধামসোনা ইউনিয়নের পানিপ্রবাহ সচল থাকে ঐতিহ্যবাহী নয়নজুলি খালের মাধ্যমে। কিন্তু সেই নয়নজুলি খাল দখল ও দূষণে শীর্ণ ধারা নিয়ে মৃতপ্রায়। বর্তমানে এর যেটুকু প্রবাহ অবশিষ্ট রয়েছে, সেটাও নিষিদ্ধ পলিথিনের কারণে আরও সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
সরেজমিন আশুলিয়ার বাইপাইল ব্রিজ এবং সংলগ্ন কাঁচাবাজার আড়ত এলাকায় নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের বাজার ঘুরে এর সত্যতা মিলেছে। কাঁচাবাজারের আড়ত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি দোকানে প্রকাশ্যে বিক্রী হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন। এই বাজারের অলিগলির দোকানপাটে সরেজমিন দেখা যায়, ক্রেতাদের অধিকাংশ মানুষের হাতেই পলিথিন ব্যাগ। তাই সব্জি, মাছ, মাংস, ডাল যাই কিনছেন, তার জন্য নিচ্ছেন আলাদা আলাদা পলিথিন ব্যাগ। এছাড়া, বিভিন্ন জেলা থেকে পিকআপে করে সব্জির আড়তে যে সব্জি আনা হয়, সেগুলোও পলিথিনে মোড়ানো। আবার এসব সব্জি বের করার পর সেগুলো উচ্ছিষ্ট হিসাবে ফেলা হচ্ছে সংলগ্ন নয়নজুলি খালে! ফলে রুদ্ধ হচ্ছে খালের প্রবাহ।
একদিকে ময়লার ভাগাড়, অন্যদিকে দখলদারদের থাবায় নর্দমায় পরিণত হয়েছে নয়নজুলি খাল। বাইপাইল ব্রিজ থেকে দক্ষিণ দিকে শ’খানিক মিটার দূরত্বে আরেকটি ছোট কালভার্ট। এখানে বেশ কয়েকটি পলিথিনের গোডাউন রয়েছে। এসব গোডাউনে আনা নোংরা পলিথিন পরিস্কার করা হয় এই খালের পানিতে। তখন পলিথিন ধোয়ার সময় এগুলোর উচ্ছিষ্ট অংশবিশেষ পানির সাথে ভেসে গিয়ে প্রবাহ রুদ্ধ করে ফেলে। ফলে এই খালের যেটুকু প্রবাহ সচল তা-ও ক্রমশ আরো সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
অন্যদিকে, এই কালভার্ট সংলগ্ন এলাকায় নয়নজুলি খালে পলিথিনে করে বিভিন্ন বাসাবাড়ির ব্যবহৃত বর্জ্য দেদারছে ফেলা হচ্ছে। ফেলা হচ্ছে স্থানীয় কসাইখানার বর্জ্য। এছাড়া, সংলগ্ন বিভিন্ন কারখানার ইটিপিবিহীন অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি এই খালে ফেলায় খালের পানির রং ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে করে বিভিন্ন রোগজীবাণুর সূতিকাগার হিসাবে পরিচিতি পাচ্ছে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী নয়নজুলি খাল। এর ফলে বর্ষা মৌসুমে অল্প বৃষ্টিতে খাল বেষ্টিত এলাকায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতার। তখন হাজার হাজার মানুষ পড়ে অবর্ণনীয় দুর্দশায়। আর বর্ষাকালে এসব পানিবাহিত রোগ বিভিন্ন এলাকায় প্রবাহিত হয়ে জনস্বাস্থ্যকে ও ফেলছে হুমকির মুখে।
বাইপাইল ব্রিজের সাথে নয়নজুলি খালের পাড়ে একটি গরুর খামার গড়ে উঠেছে। খামারের সব বর্জ্য স্তূপাকারে খালের পানিতে পড়ে থাকতে দেখা যায়। অথচ এসব বিষয়ে পরিবেশবাদী কোনো সংগঠন কিংবা উপজেলা প্রশাসনের নেই কোনো নজরদারি। তাই খাল-সংলগ্ন এলাকায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন এবং দখল ও দূষণের মাত্রা আরো বাড়ছে এই খালের।
পলিথিন মাটিতে পচে না। তবে এতে কৃষিজমির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়ে ফলন কমে যায়। পাশাপাশি যত্রতত্র পড়ে থাকায় দূষিত হয় পরিবেশ। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, বিশ্বে যে দেশটি সবচেয়ে আগে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলো সেটি আমাদের বাংলাদেশ। কিন্তু বাজারে গেলে দেখা যায় বিষয়টি মারাত্মকভাবে তার গুরুত্ব হারিয়েছে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়পক্ষের কাছেই।
পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত-বিতরণ নিষিদ্ধ। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এ আইন লঙ্ঘন করেই সাভার বাজার এবং আশুলিয়ার বাইপাইল কাঁচাবাজার আড়ত সংলগ্ন এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় দেদারছে বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ!
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশকে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগের কুফল সম্পর্কে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. একেএম রাশিদুল আলম জানান, প্লাস্টিক এমন একটি পদার্থ যার আয়ুষ্কাল হাজার হাজার বছর, যা মাটিতে গেলে ক্ষয় হয় না বা মাটির সাথে মিশে যায় না। তিনি বলেন, আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর বাংলাদেশ সরকারের ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে দেড় যুগ আগেই বাংলাদেশে পলিথিন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু নিষিদ্ধ ঘোষণার পরও এই পলিথিনের বহুল ব্যবহার হচ্ছে। সিঙ্গেল ইউজ পলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। এই পলিগুলো একবার ব্যবহার করে আমরা পরিবেশে ডিসচার্জ করি। ডিসচার্জ এর ফলে আসলে কী হয়? এই পলিগুলো সহজে পচে না। এগুলো ডিগ্রেড হতে যেহেতু অনেক সময় লাগে, এই পলিথিনগুলো পরিবেশে থেকে বিশেষ করে মাটিতে ও পানিতে থেকে ড্রেনেজ কনজেশন ঘটায়। আমাদের যে ড্রেনেজ সিস্টেম আছে সেগুলো ক্লগিং হয়ে যায়। তার ফলে পানির চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে শহর এলাকায় এই ঘটনাটা বেশী ঘটে। আবার অনেক পলিথিন আছে যেটা মাটিতে এবং পানিতে গিয়ে এসব জায়গায় বাসকরা জীবের লাইফ সাইকেলের উপর প্রভাব বিস্তার করে। অনেক বছর পরে ওই পলিথিনগুলো যখন আস্তে আস্তে ডিগ্রেড হয়ে মাইক্রো প্লাস্টিক ও মাইক্রো বিডে রুপান্তরিত হয়- সেটা আরো বেশি ক্ষতিকারক। বিশেষ করে সেটা যদি সয়েল ও পানিতে গিয়ে পানির সারফেস ফ্লোর মাধ্যমে যদি জলাভূমিতে যায়, সেই জলাভূমিতে বিদ্যমান বিভিন্ন অ্যানিমেল যেমন মাছের কথা যদি বলি- যদি এটা মাছের শরীরে যায় আর মানুষ ওই মাছ খায় তাহলে কিন্তু আলটিমেটলি সেই মাক্রো প্লাস্টিকটি মানুষের শরীরে চলে আসে। আমাদের দেশ যেহেতু নদীমাতৃক দেশ, তাই নদীপথে এটা সমুদ্রেও যেতে পারে। আর সমুদ্রে গিয়েও কিন্তু মেরিন যে অর্গানিজম আছে, তাদের লাইফের ওপরেও একটা প্রভাব বিস্তার করে। মাইক্রো প্লাস্টিক সবচেয়ে ক্ষতিকারক বিশেষ করে লো ডেনসিটি পলি ইথাইলিন (এলডিপি)।
এটি একসময় ডিগ্রেডেশন হয়ে মাছের বডিতে চলে যেতে পারে।
এই পলিথিনের ব্যবহার রোধ করতে তিনি পলিথিনের বিকল্প হিসাবে পাটের ব্যাগ কিংবা গ্রামদেশে ব্যবহৃত ডোলা ব্যবহারের পরামর্শ দেন।
এ প্রসঙ্গে ড. রাশিদুল আলম বলেন, সিঙ্গেল ইউজ পলি অলরেডি ব্যানড করেছে গভার্নমেন্ট, সেটাকে আরো জোরদার করতে হবে, যাতে সেটা এখন আর মানুষ ইউজ না করে। প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধের জন্য মানুষকে আগ্রহী করে তুলতে হবে। দ্বিতীয়ত : পলিথিনের বিকল্প হিসেবে অন্যকিছু ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে আমরা পাটের ব্যাগ কিংবা আমাদের গ্রামদেশে ব্যবহৃত হতো ডোলা, এসব ব্যবহারের অভ্যাসগুলো আমাদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। পৃথিবীতে অনেক দেশ আছে যারা এই পলিথিন ব্যবহার করে না। আমি কলকাতায় গিয়ে দেখেছি যে, তারা পাতা দিয়ে তৈরি প্লেট ব্যবহার করছে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন প্রোগ্রামে খাবার খেতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক ব্যবহার করছি। এগুলো একবার ব্যবহার করে ফেলে দিই, এটাও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। সেজন্য ন্যাচার থেকে পাওয়া যে প্রোডাক্টগুলো আছে যেমন গাছের পাতা, গাছের বাকল সেগুলো যদি ব্যবহার করতে পারি ও মানুষের মাঝে এর প্র্যাকটিস করাতে পারি, তবে পলিথিনের ভয়াবহতা থেকে পরিবেশকে আমরা রক্ষা করতে পারব। আর এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের লোকাল গভার্নমেন্ট মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে। গভর্নমেন্ট প্রপার ইনিসিয়েটিভ নিয়ে তাদের যে ফোর্স আছে তাদের দিয়ে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে। নাহলে শুধু মাটি এবং পানিতে গিয়ে প্লাস্টিক আমাদের ক্ষতি করবে না, কিছু কিছু এয়ার বর্ণ মাইক্রো প্লাস্টিক আছে যা বাতাসে ভেসে ভেসে আমাদের ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তাই এক্ষেত্রে আমাদের সবাইকে সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে।
সাভার উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ফেরদৌস ওয়াহিদ জানান, যেহেতু পলিথিন তৃণমূল পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়, তাই সর্বাগ্রে সাধারণ মানুষকে এর কুফল সম্পর্কে জানিয়ে সচেতন করতে হবে। এক্ষেত্রে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক সমাজ এবং প্রশাসনের সমন্বিত প্রয়াস দরকার। এছাড়া, পলিথিনের চালানগুলো যখন আসে, বিষয়টি তৎক্ষণাৎ আমাদের নলেজে দিলে আমাদের জন্য ব্যবস্থা নিতে সুবিধা হয়। জলাশয় দখল ও দুষণের ক্ষেত্রে সাভার উপজেলা প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও জানান তিনি।