শীতের সকালে দিগন্তজুড়ে সরিষা ফুলের সমারোহ। শিশির ভেজা সরিষার সবুজ গাছের হলুদ ফুলগুলো সোনাঝরা রোদে যেন ঝিকিমিকি করছে। যে দিকে চোখ যায়, হলুদ আর হলুদ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ এমন এক দৃশ্যের দেখা মেলে মৌলভীবাজার জেলার সর্ববৃহৎ জলাভূমি হাকালুকির হওরাঞ্চলে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় মৌলভীবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় চলতি রবি মৌসুমে বাড়ছে সরিষার চাষ। উন্নতজাতের সরিষা চাষে লাভবান হচ্ছেন এ জেলার চাষিরা। সরিষার ব্যাপক ফলনে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে সম্ভাবনার হাতছানি। সম্প্রতি বড়লেখা উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে সরিষা চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রচলিত দেশি সরিষার চেয়ে উচ্চ ফলনশীল জাতের বারি-১৪, ১৬, ১৭ ও ১৮ এবং বিনা সরিষা ৪ ও ৯ আবাদ হয়েছে। বারি-১৪ সহ অন্যান্য সরিষা বপনের মাত্র ৭৫ থেকে ৮০ দিনের মধ্যে এর ফলন পাওয়া যায়। তাতে চাষিরা সরিষা চাষে ঝুঁকেছেন। প্রতি বিঘা জমি থেকে ৬ থেকে ৭ মণ সরিষা উৎপাদনের আশা করছেন চাষিরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসেব মতে, চলতি বছরে সরিষার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৩৫০ মেট্রিক টন। যেখানে চাষ হয়েছে প্রায় ৫ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে। গত বছরের চেয়ে প্রায় ৪শ ৭৫ হেক্টর বেশি চাষ হয়েছে সরিষা। প্রতি হেক্টরে ২৮ মন সরিষা উৎপাদন হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। জানা গেছে, একই জমিতে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন হচ্ছে। আমন ধান সংগ্রহের পর জমি ফেলে না রেখে সরিষা চাষ করেছেন। এরপর আবার বোরো ধান রোপণ করবেন তারা। কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় চাষিদের সূত্রে জানা গেছে, জেলার সিংহভাগ সরিষা উৎপাদন হয় বড়লেখা উপজেলায়। এখানকার হাকালুকি হাওরের বিস্তীর্ণ মাঠ এখন হলুদ রঙে সেজেছে। পাশাপাশি ওই এলাকায় সরিষার জমির পাশেই মৌ চাষ বেড়েছে। সরিষা মাঠে কিংবা বাড়ির পাশে বাক্স বসিয়ে মৌ চাষিরা মধুও সংগ্রহ করছেন। ফলে সরিষা চাষি ও মৌ চাষি উভয়েই লাভবান হওয়ায় সরিষা চাষ বেড়েছে। চাষিরা জানান, বারি-১৪ ও বারি-১৭ সরিষা গাছের উচ্চতা হয় দেড় থেকে দুই ফুটের মতো। আগে সরিষা গাছ বড় হলেও ফলন কম হতো। নতুন জাতের ছোট আকারের এ সরিষা সঠিক পরিচর্চায় গাছের গোড়া থেকে মাথা পর্যন্ত ফল আসছে। বেশ কয়েক বছর ধরে সরিষা চাষ করছেন চাষি আজাদ মিয়া। তিনি জানান, বাজারে সরিষার দাম ভালো থাকায় প্রতি মণ সরিষা বিক্রি করা যায় ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ হাজার টাকা দরে। প্রতি বিঘায় ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকা আয় হয়। সরিষা চাষে সময় ও সেচের প্রয়োজন কম। আবার বীজের কোনো সমস্যা হয় না। সব মিলিয়ে কম খরচে বেশি লাভের জন্য বোরো লাগানোর আগে সরিষাই এখন সেরা ফসল। ব্যাপক সরিষা চাষে মৌ সংগ্রহের পরিমাণ বৃদ্ধিতে গত বছরের তুলনায় এবার বেশি আয় হবে বলে জানান, চাষি চুনু মিয়া ও ইব্রাহিম মিয়া। মৌমাছির মধু আহরণে সরিষা ফুলের পরাগায়ণে দিগন্তজুড়ে হলুদ সরিষা ফুলে স্বপ্ন বুনছেন চাষি আব্দুল খালিক। তিনি বলেন, সরকারি প্রনোদনায় জেলার সাতটি উপজেলায় সরিষার ফলন ও ফুলের মধু গ্রামীণ অর্থনীতিতে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। তবে অগ্রহায়ণ মাসের বৃষ্টিতে সরিষা আবাদে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তবে অল্প দিনে বেশি ফলনের আশায় সরিষা উত্তোলন করে ফের বোরো আবাদ করতে পারেন বলে এটাকে স্থানীয় চাষিরা লাভের ফসল হিসেবে দেখছেন বলে তিনি জানান। বড়লেখা উপজেলার উপসহকারী কৃষি অফিসার পলাশ দত্ত জানান, বিনামূল্যে বীজ, সার ও কৃষকদের মধ্যে একাধিক উঠান বৈঠক করে সরিষা চাষে তাদের উদ্বুদ্ধ করা করা হয়। এতে হাওরপাড়ের কৃষকরা সরিষা চাষে এগিয়ে আসে। কৃষকদের যথাযথ পরামর্শ ও পরিচর্যার বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেয়াতে গত বছরের চেয়ে এবার বেশি সরিষা চাষ হয়েছে। বড়লেখা উপজেলা কৃষি অফিসার মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, সরিষা মাঠে মৌমাছি ফুলের ওপর বসলে ফুলের পরাগায়নে ফসলের পুষ্টি বৃদ্ধি হয়। ফলে সরিষার ফলন ২০ ভাগ বৃদ্ধি পায়। আমন ও বোরো আবাদের মধ্য সময়ে সরিষা চাষ করা যায় বলেই কৃষকদের মাঝে সরিষা চাষের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সামসুদ্দিন আহমদ বলেন, সরিষা চাষে কৃষকদের অনুপ্রাণিত করতে সারা জেলায় ১৫ হাজার ৮০০ কৃষককে সার ও বীজ সরবরাহ করা হয়েছে। ব্যাপক সরিষা চাষের সাথে মধু চাষে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। ভোজ্যতেলের চাহিদা পূরণে সরিষা যাতে ভূমিকা রাখতে পারে সেজন্য রাজস্ব খাত থেকে সহযোগিতার মাধ্যমে সরিষার আবাদ বৃদ্ধির কাজ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।