ঠাকুরগাঁওয়ের রোড বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি (ডিজেল পাওয়ার স্টেশন) প্রায় দেড়যুগ ধরে বন্ধ হয়ে আছে। তড়িঘড়ি করে সব যন্ত্রপাতি নিলামে বিক্রিও হয়ে গেছে। সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি করে দেয়া হয়েছে। এরপর থেকেই অরক্ষিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হয়ে উঠেছে কিছু লুটেরা আর মাদকসেবীর অভয়ারণ্য।
জানা গেছে, ১৯৬২-৬৪ সালে ঠাকুরগাঁও রোড রেলস্টেশনের পাশে ডয়েজ (জার্মান) কর্তৃক ১০ দশমিক ৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ঠাকুরগাঁও ডিজেল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র’ নির্মিত হয়। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে মোট ৭টি জেনারেটর ছিল। প্রতিটি জেনারেটর ১ দশমিক ৫ মে. ও. বিদ্যুৎ উৎপাদন করত। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান জ্বালানি ছিল লাইট ডিজেল ওয়েল (এলডিও)। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ দ্বারা ওয়াপদার (যা পরবর্তীকালে পানি উন্নয়ন বোর্ড) ৩৬০টি গভীর নলকূপে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছাড়াও এই এলাকার বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা হতো। এরপরেও রংপুর পর্যন্ত এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো।
ঠাকুরগাঁও ডিজেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে উত্তরাঞ্চলের প্রথম এবং প্রধান বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। ৮০’র দশকে ডয়েজ (জার্মান) মূল কোম্পানিতে এই মডেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন করতে পারত না। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি মহল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত নিম্নমানের কিছু খুচরা যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে লুটপাট শুরু করে। এসব কারণে একদিকে যেমন বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কমে যায়, তেমনি ইউনিট প্রতি খরচ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়।
অবশেষে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ ঘোষণা করে সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি করে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বন্ধ হওয়ার পরই এর সব মালামাল ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয়ভাবে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করে দেয়া হয়। এ টেন্ডার নিয়েও নানা প্রকার অস্বচ্ছতার খবর তখন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ হয়েছিল। টেন্ডারের পরই পুরো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এলাকাটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অপর অংশটি (বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগ) নেসকো নামে কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর কার্যত বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের পুরাতন অংশটি দেখার মতো আর কেউ থাকে না।
এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে স্থানীয় একটি সংঘবদ্ধ চক্র অনেকটা প্রকাশ্যেই (দুটি কোলোনির) পুরোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরজা, জানালা, কাঁটাতার, লৌহজাত যাবতীয় পোল, খুঁটি, মাটির তলার এইচটি ক্যাবল, সাইনবোর্ড, তিন যুগের পুরোনো কাঁঠাল গাছ এমনকি ইটের দেয়াল পর্যন্ত ভেঙে নিয়ে গেছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কোটি কোটি টাকার এ সম্পত্তি পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ না করা পর্যন্ত নেসকো কর্তৃপক্ষ নজরদারিতে রাখবেন এমন কথা শোনা গেলেও নেসকো ঠাকুরগাঁওয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সিরাজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে তেমন কোনো তথ্য দিতে পারেননি। তবে বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের উচ্চমান সহকারী মোনায়েম হোসেন বলেন এগুলো পাহারা দেয়ার জন্য আনসার রাখা হয়েছে। গাছ কেটে নেয়া আর স্থাপনা ভেঙে নেয়ার কথা বললে তিনি জানান, বিষয়টি আমাদের জানা নেই, খোঁজ নিচ্ছি।
এছাড়াও পরিত্যক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকাটি দিন এবং রাতে সমানভাবে মাদকসেবীদের বিচরণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। কোনো প্রকার রাখ ঢাক না করেই দল বেঁধে মাদকসেবীরা এখানে প্রবেশ করে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশের বস্তিতে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকেই বলেন, ইট খুলে ৬ হাজার টাকা দরে কারা বিক্রি করেছে, কারা কিনেছে সবাই জানে। এখন শুরু হয়েছে গাছ কাটা। কারা গাছ কাটছে সেটাও সবাই জানে। যাদের মাল তারা বাধা দেয় না, আমরা কেন বাধা দিয়ে বিপদ ডেকে আনব? স্থানীয় সাধারণ মানুষ মনে করেন, মাদকের ভয়াল থাবা থেকে এলাকার কিশোরদের রক্ষা করতে এবং সরকারি সম্পত্তি রক্ষার্থে প্রশাসনের এদিকে দ্রুত দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।