রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের খামারি রুমানা খাতুন। প্রকল্পের আওতায় ১০টি ভেড়া পান। সেই ভেড়া থেকেই শুরু তার খামারি হওয়া। কয়েক বছরেই ঘুরেছে ভাগ্যের চাকা। ভেড়া বিক্রি করেই কিনেছেন গরু। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচও চালাচ্ছেন তিনি। বরেন্দ্র অঞ্চলে রুমানার মতো অনেকেরই ভাগ্যবদলের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়িয়েছে ভেড়া পালন। রাজশাহীতে গত কয়েক বছরে বেড়েছে ভেড়ার খামার। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বেশ ভূমিকা রাখছে ভেড়া পালন। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলের মেয়েদের জন্য বড় একটি সুযোগ করে দিচ্ছে এই ভেড়া পালন। রুমানা খাতুন বলেন, প্রথমে যে কয়টি পেয়েছিলাম, সেটি দিয়েই আমি ভেড়া পালন শুরু করি। এখন আমার কাছে প্রায় ৩০টিরও বেশি ভেড়া আছে। এগুলো ভালো দামে বিক্রি হচ্ছে। ভেড়া পালতে তেমন খরচ নেই। ভেড়া বিক্রি করে আমার বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। গবেষণা ফাউন্ডেশনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিমেল সায়েন্স বিভাগের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ‘ভেলিডেশন অব গুড প্র্যাকটিসেস অব অন-ফার্ম ল্যাম্ব প্রোডাকশন সিস্টেমস’ প্রকল্পের পর ধীরে ধীরে রাজশাহীতে ভেড়া পালন বাড়ছে। ভেড়া বাজারজাতকরণ ও আধুনিক কসাইখানাও উদ্বোধন করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজশাহীতে দুইটি দোকানে এখন শুধুমাত্র ভেড়ার মাংস পাওয়া যাচ্ছে। রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য মতে, রাজশাহীতে বর্তমানে ভেড়ার সংখ্যা ৮৫ হাজার ৯৯৪টি। ভেড়ার খামার আছে প্রায় আড়াই হাজার।
গোদাগাড়ী উপজেলার মাথাভাঙ্গা গ্রামের খামারি সুমাইয়া খাতুন বলেন, ভেড়া পালন করে গত এক বছরে ৫০ হাজার টাকার অধিক আয় করেছেন। বর্তমানে যে কয়টি ভেড়া আছে তার বাজার মূল্য এক থেকে দেড় লক্ষাধিক টাকা। তিনি বলেন, ভেড়া পালন করে আমার আয় বেড়েছে। আগেতো কোনো টাকা ছিল না। এখন বছরে কিছু টাকা আসছে। কম জায়গায় কম খরচে আমরা ভেড়া পালন করতে পারছি। এতে অর্থিকভাবে আমরা স্বাবলম্বী হচ্ছি। ভেড়া পালন করে আমাদের পারিবারিক দৈন্যদশা উল্লেখযোগ্য হারে লাঘব হয়েছে। কোর্ট বাজারে ভেড়ার মাংস বিক্রি করেন মো. জাকির হোসেন। তিনি বলেন, আমি শুধুমাত্র ভেড়ার মাংস বিক্রি করি। প্রতিদিন অন্তত তিন থেকে চারটি ভেড়া লাগে। চাহিদা আনেক। যারা একবার ভেড়ার মাংস খেয়েছেন তারা আবার এখানে এসে নিয়ে যান। ভেড়ার মাংস এখন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ টাকা কেজি দরে। রাজশাহী সরকারি ভেড়া খামারের কর্মকর্তা ডা. মো. আতিকুর রহমান বলেন, প্রাণিসম্পদেই ভেড়ার সূত্রপাত ৯০ এর দশকে। শুরু থেকেই মানুষ ছাগলকে বেশি পছন্দ করত। কিন্তু পরবর্তীতে মানুষ দেখলেন, খাদ্য সংকটের মধ্যেও ভেড়া বেড়ে উঠছে। খাদ্য সংকটের সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি যোগসূত্র আছে। এরপর থেকেই মানুষের আগ্রহ বাড়ে। তখন বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু করে। এভাবে বাংলাদেশে এখন সরকারি পাঁচটি ভেড়ার খামার আছে। এরই মধ্যে রাজশাহীতে রয়েছে একটি। তিনি বলেন, আমাদের প্রাণিসম্পদই ভেড়া নিয়ে গবেষণা করছে। এখন বেশ ভালো পালন হচ্ছে। ভেড়া পালন আনেকগুলো কারণেই ভালো। কম খাবার, কম পরিচর্যা ও বিশেষ করে এদের রোগবালাই কম। সবকিছু মিলে এটি এখন বেশ লাভজনক। রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মো. আখতার হোসেন বলেন, ভেড়ার মাংস খাশির মাংসের চেয়ে ভালো। এটিতে ইন্টারম্যাসকুলোন ফ্যাট খাসির মাংসের চেয়ে কম। এ কারণে আমাদের জেলায় ভেড়ার মাংসের চাহিদা বাড়ছে। এখানে অনেকেই এখন ভেড়ার খামার করছে। দিন দিন ভেড়ার সংখ্যাও বাড়ছে। গত কয়েক বছরের চেয়ে রাজশাহীতে এবার প্রায় ৩০ শাতাংশ ভেড়া বেড়েছে। এটি আগামীতে আরও বাড়বে বলে আশা করছি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিভাগের প্রফেসর ড. মো. জালাল উদ্দিন সরদার বলেন, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন একটি প্রজেক্ট দিয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে। ২০১৭ সলে প্রজেক্টটি শুরু হয়। এটির মূল উদ্দেশ্য ছিল বরেন্দ্র অঞ্চলে, যাতে করে ল্যাম্ব মিট বা ভেড়ার মাংসের উৎপাদন বাড়ানো যায়। এই প্রকল্পের আওতায় আমরা পবা ও গোদাগাড়ীতে ৫৯ জন খামারিকে ঘর ও ভেড়া প্রদান করি। এটির মাধ্যমে ভেড়ার উৎপাদন বাড়ানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে ভেড়ার বাজারজাত ও আলাদা কসাইখানা উদ্বোধন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ভোড়া বিক্রি করে অনেকেই ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা আয় করেছেন। তাদের দেখে এই অঞ্চলে ভেড়া পালন বাড়ছে। আমরা এটি আরো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য নতুন প্রজেক্ট পেয়েছি। আমরা পাঁচটি ভেড়ার মডেল খামার করেছি।
ড. মো. জালাল বলেন, এই অঞ্চলে ভেড়া অবহেলিত ছিল। এখন এটি আর সেই অবস্থানে নেই। এটি মানুষের কর্মসংস্থান ও আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। খামার বলতে গেলে আমরা ১০ থেকে ২০টি ভেড়া থাকলে খামার বলি। আমার মনে হয়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী-পবা-মোহনপুরে প্রায় হাজার খানেক খামার গড়ে উঠেছে। তিনি বলেন, সরকার যদি কিছুটা এগিয়ে আসে, বিশেষ করে সহজ শর্তে লোন দেয়ার ব্যবস্থা করে তাহলে ভেড়ার উৎপাদন ছাগলের সমকক্ষে চলে আসবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন ভেড়া উৎপাদনে স্বাবলম্বী হবে দেশ।