ঢাকা ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জিআই স্বীকৃতিতে টাঙ্গাইলের চমচম

আনন্দিত ব্যবসায়ীরা
জিআই স্বীকৃতিতে টাঙ্গাইলের চমচম

ঐতিহ্য আর বাংলার লোক-সংস্কৃতি ইতিহাসের উত্তরাধিকার টাঙ্গাইল জেলা। ঐতিহ্যবাহী এ জনপদের লোক-ঐতিহ্য নিয়ে প্রবাদে বলা হয়- ‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’ টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের কথাতো জানে সবাই। কেবল নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদণ্ডগন্ধেও এই মিষ্টি সেরাদের সেরা। তাইতো পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় ‘মিষ্টির রাজা’। এ চমচম পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) স্বীকৃতি। আনন্দিত ব্যবসায়ী ও চমচমপ্রেমিরা। টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আনুমানিক প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো ইতিহাস। ইতিহাস বলছেন- দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের যমুনা নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি যমুনার পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। পরে সেখানেই মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ধীরে ধীরে পোড়াবাড়িতে প্রায় অর্ধশত চমচম তৈরির কারখানা গড়ে ওঠে। এখন আর পোড়াবাড়ির সে জৌলুস আর নেই। বর্তমানে টাঙ্গাইল মিষ্টিপট্রি হিসেবে খ্যাতি পাওয়া শহরের পাঁচআনি বাজরের মিষ্টির দোকানগুলোতেও চমচম তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। এখানকার প্রতিটি মিষ্টির দোকানেই এখন নির্ভেজাল পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায়। এ পাঁচআনি বাজারে প্রায় অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানেই এখন গড়ে উঠেছে চমচমের দোকান।

চমচমের গড়ন অনেকটা লম্বাটে। হালকা আঁচে পোড় খাওয়া বলে রঙটা তার গাঢ় বাদামি। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা পোড়া ইটের মতো। বাইরেটা একটু শক্ত হলেও এর ভেতরের অংশ একেবারে নরম আর রসে টইটম্বুর। লালচে গোলাপি আভাযুক্ত ভেতরের নরম অংশের প্রতিটি কোষ কড়া মিষ্টিতে পূর্ণ। ঘন রস আর টাটকা ছানার গন্ধমাখা এ মিষ্টির স্বাদ অতুলনীয়। সুস্বাদু চমচম তৈরির মূল উপাদান দুধ, চিনি, পানি, সামান্য ময়দা ও এলাচ দানা। সংশ্লিষ্টরা জানান, চমচম একটি উপাদেয় মিষ্টান্ন, যা যে কোনো বয়সের লোকের কাছে লোভনীয়। বিয়ের অনুষ্ঠান, পূজা, জন্মদিনে, পরীক্ষায় ফলাফল, চাকরির প্রমোশন, নির্বাচনে জয়ী, নতুন চাকরি, শ্বশুরবাড়ি বা আত্মীয় বাড়ি যাওয়ার সময় এই চমচম দিয়ে শুভেচ্ছা বিনিময় এখনও সর্বমহলে প্রচলিত রয়েছে। মিষ্টির দোকানে প্রতিদিন তৈরি হয় পোড়াবাড়ির চমচম। বেশিরভাগ দোকানের মালিক নিজেরাই এ চমচম তৈরি করেন। আবার তাদের কাজের সহায়তার জন্য রয়েছে একাধিক সহযোগী। চরাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গাভীর দুধ আসে, সেগুলো অনেক ভালো। আর পানিরও একটা বিষয় আছে। দুধ, পানি ও কারিগরের সমন্বয়েই এই মিষ্টির স্বাদ হয়। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। মিষ্টি তৈরিতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না।

বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এ পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। বড় বড় মিষ্টির দোকানগুলোতে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ থেকে ১০ মণ চমচম তৈরি হয়। বর্তমানে মিষ্টি শিল্পে টাঙ্গাইলের ঘোষ ও পাল সম্প্রদায় বংশানুক্রমিকভাবে নিয়োজিত আছে। তবে দে, নাগ ইত্যাদি উপাধিধারী অনেকেও মিষ্টান্ন তৈরিতে নিয়োজিত হয়েছেন। টাঙ্গাইলের মোদক উপাধি প্রাপ্তরাও মিষ্টি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। আর জেলার পরিচিতি নির্ধারক চমচমের পাশাপাশি এখন রসগোল্লা, আমৃত্তি, জিলাপি, সন্দেশ, দানাদার, দই, খির, রসমালাই, কালোজাম, খাজা, বাতাসা, কদমা, নই টানা ইত্যাদি মিষ্টিও মন ভিজিয়েছে খাদ্য রসিকদের। কিন্তু টাঙ্গাইলের মিষ্টি মানেই পোড়াবাড়ির চমচম।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৩ অনুয়ায়ী সম্প্রতি টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি চমচম ব্যবসায়ীরা। তারা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন এরফলে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম আরো প্রসারিত হবে। জেলার অর্থনৈতিক খাতকে সুরক্ষিত রেখেছে এই চমচম শিল্প। আর এই সুস্বাদু চমচম তৈরির কাজে জড়িত রয়েছে শত শত কারিগর। আগুনের তাপে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারনেই এগিয়ে চলছে চমচমের দীর্ঘ পথচলা। নিজেদের তৈরি চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় খুশি কারিগররাও। বর্তমানে চমচম বিক্রি হচ্ছে মান ভেদে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন ছুটে আসেন মিষ্টির দোকানগুলোতে ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ নিতে। তারা জানান, পোড়াবাড়ির চমচমের স্বাদ অন্য কোনো মিষ্টির সাথে তুলনা চলে না।

টাঙ্গাইল জেলা রেস্তোরাঁ ও মিষ্টি ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, আমার বাবা ১৯৩৯ সাল থেকে মিষ্টির ব্যবসা শুরু করেন। সেখান থেকে আমিও মিষ্টির ব্যবসা করছি। আমার পরের জেনারেশনে আমার ছেলেও আছে। মূলত এ পোড়াবাড়ির চমচমের উৎপত্তি হয়েছে সেই বিটিশ আমল থেকে। চমচমের জনপ্রিয়তা এবং স্বাদ ও মান বিষয়ে স্বপন ঘোষ বলেন, চমচম সুস্বাদু হওয়ার একটা কারণ হচ্ছে- চরাঞ্চল থেকে যে সমস্ত গাভীর দুধ আসে, সেগুলো অনেক ভালো। আর জলেরও একটা বিষয় আছে। দুধ, জল ও কারিগরের সমন্বয়েই এ মিষ্টির স্বাদ হয়। মিষ্টিগুলো খুবই প্রাকৃতিক। মিষ্টি তৈরিতে কোনও ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। এসব কারণেই চমচম বিখ্যাত হয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে এ পোড়াবাড়ির মিষ্টির সুনাম রয়েছে। টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক কায়ছারুল ইসলাম জানান, তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ শিল্পটিকে আরো সমৃদ্ধ করতে কারিগরদের উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মণ্ডপরিকল্পনা রয়েছে। এটা টাঙ্গাইলবাসীর জন্য অত্যন্ত আনন্দের খবর। সামনের দিনগুলোতে চমচমের গুণগতমান অক্ষুণ্ণ রেখে কিভাবে দেশে-বিদেশে সকলের কাছে টাঙ্গাইলের চমচম একটি প্রসিদ্ধ খাদ্য শিল্প বা অন্যান্য বিষয়গুলো বিবেচনা করে তুলে ধরা যায় তারজন্য আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ব্যবসায়ী, কারিগরসহ সংশ্লিষ্টদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি চমচমের পথ চলা আরো সম্মৃদ্ধ হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত