দিনাজপুর শহরের বাসুনিয়াপট্টি দুর্গামন্দির- প্রতিনিয়ত সেখানে অনেকেরই যাতায়াত। বছর পাঁচেক আগে সেই মন্দির প্রাঙ্গণে একটি বটগাছ লাগিয়েছিলেন এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা দিলীপ ঘোষ। মন্দির প্রাঙ্গণে সুন্দর ছায়া পাবেন বলে শখ করেই এমন উদ্যোগ নেন তিনি। নিয়ম করে সেই গাছে পানি দিতেন, লালন-পালন করতেন। গাছের পরিচর্যা দেখে এলাকাবাসীরা বলতেন, এটিই তোর মেয়ে! বলে রাখা ভালো, সেই গাছের পাশেই ছিল বড় একটি পাকুড় গাছও। গত ৫ বছরে সেই গাছ যথেষ্ট বড় হয়েছে। এলাকাবাসীরা সন্তোষকে বলতেন, মেয়ে তো বড় হয়ে গেছে, এবার পাকড়ের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দাও। তিনি শুনতেন আর ভাবতেন কী করা যায়। একদিন শেষমেশ ‘মেয়ের বিয়ে’ দিতে রাজিও হয়ে যান দিলীপ ঘোষ। সবার আগে লাগবে পাত্রপক্ষ। পাত্রপক্ষের ব্যবস্থা কীভাবে হয়? খবর চাউর হতেই পাত্রপক্ষ হিসেবে রাজি হয়ে যান প্রতিবেশী মুন্না সাহা। স্থানীয় পুরোহিত বিজয় কৃষ্ণ চক্রবর্তীকে ডেকে গত ৩ মাঘ বিয়ের দিন ধার্য করা হয়। বিয়েতে বরের বাবা-মায়ের ভূমিকায় ছিলেন দিলীপ ঘোষ ও দীপ্তি ঘোষ দম্পতি এবং কনের বাবা-মায়ের ভূমিকায় ছিলেন তাদের প্রতিবেশী মুন্না সাহা ও পূর্ণিমা সাহা দম্পতি। পাত্র নাহয় হলো, কিন্তু বিয়ের খরচও তো প্রচুর! কী হবে? গ্রামের মানুষের কাছে সাহায্যের আবেদন রাখা হয়েছিল। লোকের মুখে মুখে এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই এগিয়ে এলেন প্রচুর গ্রামবাসী। অর্থ সাহায্য আসতে শুরুও করে। এরপর শুরু হয় বিয়ের বাজার। কেনা হয় টোপর, সিঁদুরসহ বিয়ের অন্যান্য সামগ্রী। যৌতুক হিসেবে কেনা হয় সোনার দুল ও আংটি।
বিয়ের দিন সকাল থেকে শুরু হয় সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান, হয় হলুদ কোটা। এরপর কোটা হলুদসহ তেল-সিঁদুর গাছে মাখিয়ে গাছকে গোসল করানোর পর সকালে পুরোহিত বিয়ের কাজ শুরু করেন। সন্ধ্যা নামতেই আসে বরযাত্রী। আলোকোজ্জ্বল প্যান্ডেলে ব্যান্ড বাজিয়ে তাদের বরণ করা হয়। পরদিন কন্যাদানের মাধ্যমে শেষ হয় বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষ্যে বিশাল ভোজের আয়োজন করা হয়। অতিথিদের আপ্যায়নে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজনে ছিল খিচুড়ি ও সবজি। রাতে আয়োজন করা হয়েছে কবিগান ও পালাকীর্তনের। পাত্রের বাবা দিলীপ ঘোষ (বটের বাবা) বলেন, ৫ বছর আগে দিনাজপুর শহরের ফুলতলা শ্মশান এলাকায় বট-পাকুড় লাগানো অবস্থায় পান তিনি। পরে সেটিকে এনে শহরের চকবাজার চণ্ডীমন্দির চত্বরে একটি টবে লাগান। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বাসুনিয়াপট্টি দুর্গামন্দির চত্বরে স্থাপন করেন। পাকুড়ের বাবা মুন্না সাহা বলেন, ‘সকাল থেকে হলুদ কোটাসহ বিয়েতে যা যা নিয়ম করতে হয় সব করা হয়। রাতে বরযাত্রী এলো। কন্যাদান করলাম। আমি সবার কাছে সাহায্যের আবেদন রেখেছিলাম। সবাই পাশে দাঁড়িয়েছে। আজ আমার মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। কান্নায় আমার চোখ ভেঙে জল আসছে।’ মা পূর্ণিমা সাহা বলেন, ‘মেয়ের বিয়ে দিলাম। বিয়েতে সোনাসহ যাবতীয় জিনিসপত্র দেয়া হয়েছে। সবার সাহায্য নিয়ে মেয়েকে পার করলাম।’ বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি স্বর্ণা রানী রায় বলেন, ‘বট-পাকুড়ের বিয়ের কথা এত দিন শুনেছি। আজ নিজের চোখে দেখলাম। মানুষের বিয়ের মতোই আয়োজন করা হয়েছে। বিয়েবাড়ির আয়োজনে শরিক হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।’ বট-পাকুড় গাছের বিয়ের পুরোহিত বলেন, ‘অনেক রীতি-নিয়ম মেনে, মানুষের বিয়ের মতোই বট ও পাকুড় গাছের বিয়ের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। এই বিয়ের মাধ্যমে পরলোকগমনের পরও শান্তিতে থাকব।’ গাছের বিয়ের ব্যাপারে বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দিনাজপুর নাট্য সমিতির সভাপতি চিত্ত ঘোষ বলেন, ‘প্রকৃতি ও ব্যক্তির মঙ্গল কামনায় বট-পাকুড়ের বিয়ে দেয়া হয়। শহরের বাসুনিয়াপট্টি দুর্গামন্দিরে চকবাজার এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীর মানুষ প্রকৃতির মঙ্গল কামনায় এমন বিয়ের আয়োজন করেছেন। বিয়ে ঘিরে ব্যাপক আনন্দ-উৎসব হয়েছে। বট-পাকুড়ের বিয়ে আসলে পরিবেশ সংরক্ষণের বার্তা। বট এমন গাছ, যে প্রকৃতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। দূষণ কমানোর ক্ষমতা এর খুবই বেশি। একটি পূর্ণবয়স্ক বট বিপুল অক্সিজেন দিয়ে থাকে। প্রচুর পাখি বটফল খেয়ে বেঁচে থাকে। বট গাছে প্রচুর পশু-পাখি বসবাস করে। এ ধরনের গাছের সংরক্ষণ জরুরি।’