সাভারের গোলাপ গ্রাম

বাম্পার ফলন হলেও শঙ্কায় চাষিরা

প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তুহিন আহামেদ, আশুলিয়া

আসছে বসন্ত, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এবং ২৬ মার্চ এই তিন দিবসকে ঘিরে সাভারের গোলাপ গ্রামে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। গোলাপের বাম্পার ফলন হলেও অজানা ছত্রাকের আক্রমণের কারণে চাষিদের দিন কাটছে শঙ্কায়। ফাল্গুনের শুরু বসন্ত বরণ ও ভালোবাসা দিবসের আগে পচন রোগে গোলাপ গাছের ডাল, পাতা ও কুঁড়ি ঝরে পড়ছে। ফুল ফুটলেও ছত্রাকের আক্রমণে গোলাপ খেতেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। যেসব খেতে গোলাপ ফুটেছে তার পরিমাণও কম। অতিমাত্রায় শীত, কুয়াশা ও অসময়ে বৃষ্টির কারণে গোলাপ খেতের এই সর্বনাশ ঘটেছে বলে দাবি চাষিদের। তবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাভার উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এবছর ২৩০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়েছে। ১৯৯০ সালে মিরপুর থেকে এসে বিরুলিয়ায় প্রথম গোলাপের চাষ শুরু করেন সাদেকুল নামের এক ব্যক্তি। তার বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ দেখে স্থানীয়রাও উদ্বুদ্ধ হয়ে শুরু করেন গোলাপের চাষ। চাষিরা লাভবান হওয়ায় ইউনিয়নের মোইস্তাপাড়া, সামাইর, শ্যামপুর, সাদুল্লাপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে গোলাপ চাষ। এখানে মেরিন্ডা, হাজারি, লিংকন, পাপা মিলন, বধূয়া বা হলুদ ও সাদা গোলাপের চাষ হয়। তবে বাজারে চাহিদা বেশি লাল মেরিন্ডার। এ গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষেরই প্রধান জীবিকা ফুল চাষ।

সরেজমিন বিরুলিয়া ইউনিয়নের গোলাপ গ্রামের ছোট কালিয়াকৈর, বাঘœীবাড়ী, মইস্তাপাড়া, কাকাবর, সামাইর, সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর, আকরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় দেখা গেছে, এই অঞ্চলের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে গোলাপ বাগান। সাদা ক্যাপ মোড়ানো গোলাপের কুঁড়ি বাতাসে দুলছে। গত বছরের তুলনায় এবছর গোলাপের উৎপাদন বেশি হয়েছে। তবে ছত্রাকের কারণে অধিকাংশ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গাছের পাতা, ডাল কিংবা কুঁড়ি পচে ঝরে যাচ্ছে। কীটনাশক বা ছত্রাকনাশক স্প্রে করেও মিলছে না সমাধান। অনেক গাছের শাখা-প্রশাখা লালচে হয়ে আবার কালো হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও গাছের পুরো অংশই কালো হয়ে গেছে। কলি আসলেও ফুল না ফুটেই ঝরে যাচ্ছে।

কৃষকদের দাবি, কৃষি কর্মকর্তাদের জানিয়েও কিংবা তাদের দেয়া পরামর্শে প্রতিকার মিলছে না। অধিকাংশ কৃষকের অভিযোগ, কৃষি কর্মকর্তারা মাঠে এসে কোনো পরামর্শ দেন না।

শ্যামপুর গ্রামের আব্দুল খালেক চার বিঘা জমি গোলাপ চাষ করেছেন। তিনি বলেন, এবছর গোলাপ গাছে পচা রোগ লেগেছে। গাছের পাতা, ডাল, কুঁড়ি পচে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকমের ওষুধ দিয়েও আশানুরূপ কাজ হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এখানে পরিদর্শন করেন। তবে তারা কোনো পরামর্শ কিংবা কোনো কিছুই বলেন না। এখানে এসে তারা মরা ফুল, পাতা নিয়ে চলে যান।

এই গোলাপ চাষি আরো বলেন, কৃষি প্রধান এই দেশে সবকিছুরই গবেষণা করা হয়। কিন্তু গোলাপের উপর কোনো গবেষণা নেই। লাখ লাখ টাকা খরচ করে গোলাপ ফুল চাষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত করা হয়। এই শিল্প থেকে শত শত মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হয়, গোলাপ ফুলে ছত্রাক কিংবা নানা রোগের যখন আক্রমণ ঘটে তখন এই শিল্প রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। এই শিল্প রক্ষা নিয়ে কোনো গবেষণা করা হয় না বলে তিনি আক্ষেপ করেন।

তবে নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক স্প্রে করছেন বলেও জানান এই চাষি। আরেক ফুল চাষি মাসুদ রানা দাবি করেন, লক্ষ্যমাত্রার তিন ভাগের এক ভাগ ফুলও তিনি তুলতে পারেননি। কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগেই সব পচে গেছে। যেটুকু ফুল ফুটেছিল তাও রোগাক্রান্ত, ফলে কাঙ্ক্ষিত দাম পাননি।

তিনি বলেন, এবছর অজানা ছত্রাক রোগের কারণে ফুল উৎপাদন কম হয়েছে। কিন্তু খরচ হয়েছে বেশি। প্রথমে গাছের পাতায় কিছু কালো দাগ আসে। এরপর ধীরে ধীরে পাতা পড়ে কাণ্ডে পচন লাগে। তারপর ফুল ফোটার আগেই কুঁড়ি নষ্ট হয়ে যায়। অপর এক ফুল চাষি নাজিমুদ্দিন জানান, গত কয়েক দিন ধরেই বেচা-বিক্রি বেশি। তবে যতটুকু আমরা আশা করেছিলাম ততটুকু ফুল বিক্রি করতে পারছি না। গত কয়েক দিন আগেই প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০টি ফুল তোলা গেছে। কিন্তু বর্তমানে ৫০টাও পাওয়া যায় না। ছত্রাকের কারণে কুঁড়ি থেকে ফুল ফোটার আগেই সব পচে গেছে। এতে চাহিদা থাকলেও বিক্রি করা যাচ্ছে না। এখন সঙ্কা কাজ করছে।

সাভার উপজেলা অতিরিক্ত কৃষি কর্মকর্তা ইশরাত জাহান জানান, সাভার উপজেলায় এবার ২৩০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়েছে। এবছর প্রায় ৪০ কোটি ফুল বিক্রি হবে বলে লক্ষমাত্রা ধরা হয়েছে। চাষিরা লাভবান হবেন। গোলাপে ছত্রাকের আক্রমণের ব্যাপারে জানান, ‘আমরা উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে প্রতিনিয়ত সেখানে পরিদর্শন করি। চাষিদের সাথে উঠান বৈঠক, বাগানের পাশে, ফুল বাজারের পাশে ফেস্টুনসহ নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। এছাড়া ছত্রাকের আক্রমণ ঘটলে কি ওষুধ প্রয়োগ করা হবে তার ব্যবস্থাপত্রও দেয়া হয় কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস ওয়াহিদ আলোকিত বাংলাদেশকে জানান, গোলাপ গ্রাম, এটা একটা বিখ্যাত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সাভারে। এখানে কোনো কৃষক যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেক্ষেত্রে আমরা সরকারকে অবশ্যই অবগত করলে আমরা সরকার থেকে সহযোগিতা পেতে পারি। আর প্রোডাকশন যদি ফল করে তাহলে আমাদের কৃষি কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানাব যাতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।