ঢাকা ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের দখলে হল নিয়মিতদের স্থান হয়েছে গণরুমে

অবৈধ শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় হাজারের মতো
মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের দখলে হল নিয়মিতদের স্থান হয়েছে গণরুমে

দেশের সবুজ স্বর্গখ্যাত প্রাণ-প্রকৃতির আশ্রয়স্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সম্প্রতি আবাসিক সংকট প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থানরত ১৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে অবৈধ শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৫০০ জন। এতে মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্ররা সিট দখল করে থাকায় কৃত্রিম সিট সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে প্রথমবর্ষের শিক্ষার্থীদের থাকতে হচ্ছে মিনি গণরুমে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধর্ষণের ঘটনায় গঠিত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম ‘নিপীড়নবিরোধী মঞ্চ’-এর পাঁচ দফা দাবির মধ্যে হল থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্রদের বের করার দাবিটিও ছিল। তাদের দাবি মেনে গত ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত হয় ৫ কর্মদিবসের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ছাত্র ও পোষ্য কোটায় ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ত্যাগ করতে হবে। গত রোববার ৫ কর্মদিবস সময় শেষ হয়ে গেলেও কতজন মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী আবাসিক হল ছাড়া করা হয়েছে এবং কতজন নতুন শিক্ষার্থীকে আসন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা জানান হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগে সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীদের অধিকাংশই অবৈধ শিক্ষার্থী। এমনকি জাবি শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল ও সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন উভয়েই অবৈধ শিক্ষার্থী। ছাত্রলীগে অবৈধ শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাদের ছত্রছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে প্রায় ১ হাজার এরও অধিক অছাত্র অবস্থান করছে।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, চারুকলা বিভাগ ও ফার্মেসি বিভাগ ছাড়া বাকি সব বিভাগে ৪৫ ও ৪৬তম ব্যাচের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। তবে এখনও ৪৩, ৪৪, ৪৫ ও ৪৬তম ব্যাচের প্রায় ২ হাজার শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সিনিয়র ব্যাচের অনেক শিক্ষার্থীই অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছেন। আবার চার জনের আসনের একটি কক্ষে দুইজন, দুইজনের কক্ষে একজন করে থাকছেন সিনিয়ররা। অবৈধভাবে অবস্থান করা এসব শিক্ষার্থীদের চাপ পড়ছে বৈধ শিক্ষার্থীদের ওপর। দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জায়গা হয়েছে গণরুমে। এক কক্ষের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে গাদাগাদি করে থাকছেন ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ৪ শতাধিক নেতাকর্মীর মধ্যে বড় অংশের ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। এমনকি মাস্টার্সে অকৃতকার্য হওয়া অছাত্রদের সেই তালিকায় স্থান পেয়েছেন কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। এরপরও বিশেষ ছাত্রত্ব দেখিয়ে রাজনীতি করেছেন তারা। তার ওপর সংগঠনের গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে কমিটিতে রাখা হয়েছে ৪০০ জনের উপরে নেতাকর্মীকে। এদের মধ্যে বর্তমানে ২৭০ জনের উপরে ছাত্রত্ব নেই যা মোট নেতার প্রায় ৭০ শতাংশ।

কমিটিতে ৪২তম ব্যাচের দুইজন রয়েছে। এর মধ্যে সভাপতি একজন। যিনি বিশেষ ছাত্র। মাস্টার্সে অকৃতকার্য হওয়ার দলে আছেন। ৪৩তম ব্যাচের ৩২ জন। এর মধ্যে সাধারণ সম্পাদক রয়েছে। তিনিও মাস্টার্সে অকৃতকার্য হওয়া বিশেষ ছাত্র।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১২ হাজার ৫৩৩ জন বৈধ শিক্ষার্থী আছে। এই শিক্ষার্থীদের জন্য ২১টি আবাসিক হল আছে। তবে এর মধ্যে চারটি এখনো চালু হয়নি। সেগুলো চালু হলে আসনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ হাজার ৩৬২টি। সে হিসেবে এখন হলগুলোতে ১০ হাজার ৩৬২টি আসন রয়েছে। তবে হলগুলোতে অনেক অবৈধ শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য শৃঙ্খলাসংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮ এর ৫ (ট) ধারা অনুযায়ী, স্নাতকোত্তর পরীক্ষাসম্পন্ন হওয়ার সাত দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ আবাসিক হল ত্যাগ করার বিধান রয়েছে। এর ব্যত্যয়ে প্রশাসন পরীক্ষার ফলাফল স্থগিত করবে। তবে কাগজে-কলমে থাকা এই বিধান মানেন না অনেকেই। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেরও তেমন উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী একজন নিয়মিত শিক্ষার্থী সর্বোচ্চ ৬ বছরে স্নাতক ও ২ বছরে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা শেষ করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে ৮ বছরে পড়াশোনা শেষ করতে না পারলে ভিসির বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এটাই কাজে লাগায় ছাত্রলীগ। তবে তখন তিনি আর নিয়মিত ছাত্র হিসেবে বিবেচিত হবেন না।

শহীদ রফিক জব্বার হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক শাহেদ রানা বলেন, হলে আসন বরাদ্দ পাওয়া ৫২ ব্যাচের ১৮৫ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে এলোটমেন্ট ফর্ম ফিলাপ করেছে ১২৫ জন শিক্ষার্থী এবং হলে অবস্থান করছে ৯০ জন শিক্ষার্থী। ৪৫ ব্যাচের মাত্র ২০ জন শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছে যারা কিছুদিন সময় চেয়ে নিয়েছে। ৪৪ ব্যাচের পাঁচজন শিক্ষার্থী হলে অবস্থান করছে।

মওলানা ভাসানী হলের প্রভোস্ট হুসাইন মো. সায়েম বলেন, ২৩২ জন ৫২ ব্যাচের নবীনদের মধ্যে হলে ২৩২ জনের মধ্যে ফর্মপূরণ করে ১৩২ জন। অবস্থান করছে ৯২ জন। ৮০ জন অছাত্রের মধ্যে হলে অবস্থান করছে ৪০ জন। এর আগে, ভর্তি পরীক্ষার সাত মাস পরও ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সশরীরে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। পরে মাসে হল চালু করে নবীনদের সশরীরে ক্লাস শুরু করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। জানা যায়, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা গত বছরের ১৮ জুন শুরু হয়ে ২৪ জুন শেষ হয়। এরপর দীর্ঘ পাঁচ মাস পার হলেও ক্লাস শুরু করতে পারেনি প্রশাসন। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) গত ৩১ অক্টোবর ৯, ১৬ ও ২৩ নভেম্বর ক্লাস শুরু করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ব্যর্থ হয় প্রশাসন। পরে গত ৩০ নভেম্বর অনলাইনে ক্লাস শুরু হয় এবং ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সশরীর পাঠদান শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যিালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তফা ফিরোজ বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণা নিয়ে কাজ করি। কতজন মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থী হল ত্যাগ করেছে বা কতজন নতুন শিক্ষার্থী উঠেছে এ নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আমার কাছে নেই। সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য জানতে উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলমকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত