কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলে ঘন ঘন দুর্ঘটনার কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েছে। যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। মূলত গতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না থাকায় দুর্ঘটনা বাড়ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, টানেলের ভেতরে গতিসীমা বেঁধে দেয়া হলেও মানছেন না অনেক চালক। উদ্বোধনের পর গত তিন মাসে টানেলের ভেতরে-বাইরে দুর্ঘটনা ঘটেছে সাতটি। এতে দুজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন অন্তত ২০ জন। কার রেসিং, টানেলের ভেতর গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলা, নির্ধারিত গতিতে গাড়ি না চালিয়ে কম-বেশিতে চালানো এসব দুর্ঘটনার কারণ বলে জানান দায়িত্বশীলরা। আর এসব দুর্ঘটনার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই থানায় মামলা হয়নি। এতে পার পেয়ে যাচ্ছেন দুর্ঘটনায় জড়িতরা।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়ার পর থেকে তিন মাসে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে টানেলের ভেতর ঘটেছে তিনটি। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কে তিনটি এবং পতেঙ্গা প্রান্তে ঘটেছে একটি দুর্ঘটনা। টানেলে একের পর এক দুর্ঘটনার জন্য গতি নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ না নেয়াকে দায়ী করছেন কর্মকর্তারা। টানেলে এখনো বসানো হয়নি স্পিড ক্যামেরা। এ প্রসঙ্গে সেতু কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী (টোল ট্রাফিক) তানভীর রিফা বলেন, ‘টানেলে স্পিড লিমিট ৬০ কিলোমিটার উল্লেখ করা আছে। অনেকেই এর কম-বেশি গতিতে চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। এজন্য টানেলের ভেতর-বাইরে স্পিড ক্যামেরা বসানোর বিকল্প নেই। বর্তমানে সিসি ক্যামেরা দিয়ে টানেলে যানবাহন মনিটরিং করা হচ্ছে। টানেলে মোট ১১০টি সিসি ক্যামেরা আছে। আনোয়ারা প্রান্তে থাকা নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে এসব সিসি ক্যামেরা মনিটরিং করা হচ্ছে।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি শনিবার রাতে টানেলের ভেতর প্রাইভেট কার-মাইক্রোবাসসহ একে একে পাঁচটি গাড়ির মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে চারজন আহত হয়েছেন। কর্ণফুলী থানার এসআই বিল্লাল হোসেন জানান, শনিবার রাতে একটি গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টানেলের দেয়ালে ধাক্কা দেয়। পরে আরো বেশ কয়েকটি গাড়ি পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে গাড়িগুলো। এতে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তÍ হয় তিনটি প্রাইভেট কার ও দুটি মাইক্রোবাস। আহত হন প্রাইভেট কার চালকসহ চারজন। পরে কর্তৃপক্ষ গাড়ি দুটি উদ্ধার করে টানেলের বাইরে নিয়ে যায়। এর আগে গত ৩০ জানুয়ারি ভোরে টানেলের সংযোগ সড়কের আনোয়ারা প্রান্তে ট্রাকের ধাক্কায় এক বাইসাইকেল আরোহী নিহত হন। আহত হন আরো দুই বাইসাইকেল আরোহী।
১৮ জানুয়ারি সকালে টানেলের ভেতর দিয়ে আনোয়ারা প্রান্তে থেকে পতেঙ্গা প্রান্তে যাচ্ছিল মুরগিবাহী একটি পিকআপ। গাড়িটি টানেল অতিক্রম করার সময় চাকা ফেটে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে টানেলের টিউবে ধাক্কা দেয়। এতে ডেকোরেশন বোর্ড ভেঙে যায় এবং অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জামের ক্ষতি হয়। ঘটনার পর সিসিটিভি ক্যামেরায় দেখার পর গাড়িটি সরিয়ে নেয়া হয়। এ সময় গাড়িতে থাকা দুজন আহত হন। গত ১৬ জানুয়ারি টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে দ্রুতগতির মাইক্রোবাসের ধাক্কায় সিকিউরিটি পোস্ট গুঁড়িয়ে যায়। এতে দায়িত্বরত নৌবাহিনীর এক সদস্যসহ সাতজন আহত হন। সকাল সাড়ে ৬টার দিকে টানেল সড়কের বৈরাগ এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ১৬ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৬টার দিকে আনোয়ারা উপজেলার চাতরী চৌমুহনী থেকে ছয়জন যাত্রী নিয়ে পতেঙ্গা প্রান্তে যাচ্ছিল একটি মাইক্রোবাস। টানেলের সংরক্ষিত সড়কে প্রবেশের আগমুহূর্তে দ্রুতগতির গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সিকিউরিটি পোস্টে গিয়ে পড়ে। এতে পোস্টটি গুঁড়িয়ে গেলে দায়িত্বরত নৌবাহিনীর এক সদস্যসহ সাতজন আহত হন। এর আগে গত ১০ নভেম্বর টানেলের পতেঙ্গা প্রান্তে ওয়াই জংশন-সংলগ্ন এলাকায় বাসের ধাক্কায় আবুল হোসেন নামে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বাসিন্দা নিহত হন। গত বছরের ৩ নভেম্বর রাত ৯টায় টানেলের ভেতর বাসের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায় একটি প্রাইভেট কার। এতে প্রাইভেট কারের ভেতর থাকা চার যাত্রী আহত হন। ৩০ অক্টোবর আনোয়ারা প্রান্তে টোল প্লাজা-সংলগ্ন এলাকায় একটি প্রাডো গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে দুর্ঘটনা ঘটে। এতে গাড়িতে থাকা চালক আহত হন।
উদ্বোধনের দিন গত ২৯ অক্টোবর মধ্যরাতে টানেলের ভেতর কার রেসিং প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল উঠতি বয়সি একদল যুবক। দামি স্পোর্টস কার নিয়ে বিপজ্জনক গতিতে প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে তারা। মোটর রেসের বেশ কয়েকটি ভিডিও ৩০ অক্টোবর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এই রেসে প্রায় ১০টি প্রাইভেট কার অংশ নেয়। এ ঘটনায় ১ নভেম্বর রাতে নগরীর কর্ণফুলী থানায় মামলা করা হয়। সড়ক পরিবহণ আইনে মামলাটি দায়ের করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল কর্তৃপক্ষের সহকারী ম্যানেজার মো. জাহাঙ্গীর আলম। মামলার এজাহারে কারের নম্বর উল্লেখ করে সাতটি কারের অজ্ঞাতনামা চালকদের বিরুদ্ধে এ মামলা করা হয়।