ভাষাশহীদ আবদুস সালামের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই তার নামে নির্মিত স্মৃতি জাদুঘরে। যদিও শহীদ সালামের পিতা ফাজিল মিয়ার বেঁচে থাকতে তার নিকট ছেলের গুলিবিদ্ধ একটি রক্তাক্ত শার্ট ও দুটি আলোকচিত্র ছিল। ষাটের দশকে জাতীয় জাদুঘরে দেবেন বলে সেটি নিয়ে যান ফেনীর তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য খাজা আহমদ। পরে তিনি শহীদ সালামের রক্তাক্ত শার্ট ও ছবি দুটি কী করেছেন, তা আজও অজানা। বর্তমানে শহীদ সালামের যে ছবিটি পাওয়া যায়, তাও হাতে আঁকা। এঁকেছেন শিল্পী শাহাজাহান আহমেদ বিকাশ। ফলে সারা বছর এ জাদুঘরে কেউ তেমন একটা যায় না। গুরুত্ব বাড়ে কেবল ফেব্রুয়ারি মাস এলেই। এছাড়া সেখানেই একই ভবনে নির্মিত ভাষাশহীদ সালাম স্মৃতি গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মো. লুৎফর রহমান বাবলু বলেন, গ্রন্থাগারে সাড়ে ৩ হাজার বই রয়েছে; প্রায় সবগুলোই পুরোনো। এর একটিও নেই শহীদ আব্দুস সালামকে নিয়ে লেখা। তাই বছরজুড়ে গ্রন্থাগারটি সর্বসাধরণের জন্য খোলা রাখা হলেও পাঠকের আনাগোনা তেমন থাকে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের সালাম নগরে (লক্ষ্মণপুর) গ্রামে ভাষাশহীদ সালামের স্মৃতি রক্ষার্থে তার নামে নির্মাণ করা হয় এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি। শহীদের জন্মস্থান এ গ্রামটি ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কের পাশে দাগনভূঞা উপজেলা সদর থেকে ২ কিলোমিটার ও ফেনী শহর থেকে ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভাষাশহীদ আবদুস সালামের বাড়ির অদূরে ‘আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরটি’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। গত সোমবার সরেজমিনে গিয়ে একতলা ভবনের ওই গ্রন্থাগারের ভেতরে ঢুকতেই দেখা যায় বড় একটি হলরুম; দেয়ালে টানানো ভাষাশহীদের ছবি। ১১টি আলমারিতে হাজার তিনেক বই আর ছয়টি টেবিল; সঙ্গে কিছু চেয়ার। আলমারিতে বই ঠাসা থাকলেও পাঠক নেই। জাদুঘরে শহীদ সালামের একটি ছবি ছাড়া আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। ভবনের সামনে মাঠের এক পাশে ভাষাশহীদ আবদুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। পাশেই গড়ে উঠেছে বেশ বিছু দোকানপাট। অপর পাশে শহীদ মিনার আর উন্মুক্ত মাঠ। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সিলোনিয়া নদী। জানতে চাইলে সালামনগর গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ভাষাশহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগারে হাজারো বই থাকলেও পাঠক নেই। বছরজুড়ে সুনশান নীরবতা থাকলেও ফেব্রুয়ারি মাসে থেকে শুরু হয় গণমাধ্যমকর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ বিভিন্ন স্তরের শ্রেণি-পেশার মানুষের আনাগোনা। ঘটা করে একুশে ফেব্রুয়ারির নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তাছাড়া প্রতিষ্ঠালগ্নে যে কয়েক হাজার বই গ্রন্থাগারে দেয়া হয়েছিল, সেগুলো এখনো আলমারিতে সাজানো রয়েছে। তার মধ্যে কিছু বই নষ্ট হলেও নতুন কোনো বই আর যোগ হয়নি। এজন্য লোকজনও খুব একটা আসে না। জেলা পরিষদ থেকে একজন লাইব্রেরিয়ান ও একজন কেয়ারটেকার নিয়োগ দেয়া হয়েছে; তারাও অলস সময় কাটান।
এছাড়া শহীদদের পরিবার ও স্বজনদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পর ২০১৭ সালে রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে আবদুস সালামের কবর শনাক্ত করা হয়। তাকে স্মরণীয় করে রাখতে তার গ্রামের নাম পরিবর্তন করে সেটিকে ভাষাশহীদ আবদুস সালাম নগর গ্রাম করা হয়েছে। ফেনী শহরের ভাষাশহীদ সালাম স্টেডিয়ামের নামে একটি স্টেডিয়াম ও একটি কমিউনিটি সেন্টারেরও নামকরণ করা হয়। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নাম করা হয় ভাষাশহীদ আবদুস সালাম।
অন্যদিকে, ভাষাশহীদ সালাম নগর গ্রামে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করেন ভাষাশহীদ সালাম মেমোরিয়াল কলেজ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ২০০০ সালে ভাষাশহীদ সালামকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তবে, তাদের দাবি, শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সবাই আমাদের খোঁজেন। কর্মসূচি পালন করেন। এখানে একটি বিনোদন পার্ক ও একটি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এতে গ্রন্থাগারে পাঠকের শূন্যতাও পূরণ হবে। মানুষ ভাষা আন্দোলন ও শহীদ সালামকে জানার সুযোগ পাবে।’
এদিকে শহীদের নিজ উপজেলার বাসিন্দাদের নিকট জানতে চাইলে তারা, ভাষাশহীদ সালামের স্মরণে দাগনভূঞা উপজেলা শহরের জিরো পয়েন্টের ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কের বসুরহাট, ফাজিলের ঘাট ও নামার বাজারসহ পাঁচ রাস্তার মোডে শহীদের ছবি সংবলিত একটি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন, যেখানে থাকবে ভাষা আন্দোলনের বর্ণমালা প্ল্যাকার্ড, ব্যানার, শহীদ মিনার, রক্তিম সূর্য, চারপাশের উপরাংশে অপর ভাষাশহীদ ছবি ও নিচে ভাষাসৈনিকদের নাম এবং একটি পানির ফোয়ারা ও নান্দনিক আলোকসজ্জা। তহলেই এ উপজেলাসহ অত্রঅঞ্চলের মানুষের মধ্যে অমর হয়ে থাকবে এ ভাষাশহীদ। তার জন্ম এ উপজেলায় হয়েছিল, এটি কারোরই অজানা থাকবে না। জানতে চাইলে ফেনী জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (অতিরিক্ত সচিব) আজগর আলী বলেন, জেলা পরিষদের দায়িত্ব স্থাপনাটি রক্ষনাবেক্ষণ করা। গ্রন্থাগারে পর্যাপ্ত বই আছে। লাগলে আরো বই জেলা পরিষদ থেকে দেয়া হবে। গ্রন্থাগারে একজন কেয়ারটেকার ও একজন লাইব্রেরিয়ান আছে। ভেতরের কিছু আসবাবপত্র নষ্ট হয়ে গেছে। অতি সম্প্রতি পরিদর্শন করে সেগুলো মেরামত/ক্রয়ের জন ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলা পরিষদ থেকে ২ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দিয়েছি। তবে এটি পাঠক এবং দর্শক আকর্ষণে উপযোগী করতে স্থানীয়দের উদ্যোগ নিতে হবে।
ফেনী জেলা প্রশাসক মোসাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, “ভাষাশহীদ সালামের গ্রামের সঙ্গে আমাদের আগামী প্রজন্মকে কীভাবে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা যায়, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে ভাষাশহীদ সালামের স্মরণে শহরের জিরো পয়েন্টের পাঁচ রাস্তার মোডে শহীদের ছবি সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন একটি স্থাপত্য নির্মাণের বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।
প্রসঙ্গত, আবদুস সালামের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন নোয়াখালী জেলার ফেনী মহকুমার দাগনভূঞা থানার লক্ষণপুর গ্রামে (বর্তমানে ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের সালামনগর গ্রাম)।
জানা যায়, বাল্যকালে পাশবর্তী কৃষ্ণরামপুর স্কুলে প্রাথমিক এবং কলিমুল্লাহ মাইনর স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর আতাতুর্ক স্কুলে ভর্তি হন সালাম। দশম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় আর্থিক অনটনে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। এরপর কাজের সন্ধানে তিনি চলে যান কলকাতায় বড় বোনের স্বামী আব্দুল কাদেরের কাছে। মেটিয়াবুরুজে তার বড় বোনের স্বামী থাকতেন তখন, তিনিই কলকাতা বন্দরে কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন তাকে। দেশভাগ হয়ে গেলে বোনের স্বামী সহ ফিরে এলেন ঢাকায়। পিয়ন হিসেবে কাজ পেলেন তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের ডিরেক্টর অব ইন্ডাস্ট্রিজ বিভাগে। ওই সময় নীলক্ষেত ব্যারাকের ৩৬/ বি নং কোয়ার্টারে থাকতেন সালাম।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি অন্যান্য দিনের মতো নীলক্ষেতের বাসা থেকে অফিসে যাচ্ছিলে তিনি। সেদিন অফিসে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে দেখেন আমবাগানের সামনে ছাত্রদের বিশাল জটলা। তিনি সাইকেল থামিয়ে মিছিলে যোগ দেন।
শহীদের ছোট ভাই আব্দুল করিম বললেন, ‘ভাই তো আগের থেকে ছাত্র আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের মুখে শোনা, তিনি নাকি মিছিলের সামনে ছিলেন। যখন পুলিশ গুলি করল তিনি পড়ে গেলেন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলো।’
অথচ ‘আমরা জানলাম যেদিন গুলি লেগেছে সেদিন রাতে। হাবিবুল্লাহ নামে আমার এক জ্যাঠাতো ভাই তাকে মেডিকেলে নিয়ে যান। পরে বাড়িতে খবর পাঠানো হয়। বাড়ি থেকে আব্বা, জ্যাঠা আরও দুই তিনজন ঢাকা যান। আমার আম্মা যাননি। তিনি বাড়িতে ছিলেন, তবে মিছিলে ভাইয়ের গায়ে গুলি লেগেছে এটা শোনানো হয়নি তাকে। নয়তো ভেঙ্গে পড়তেন।’
তিনি বলেন, ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে পুলিশের অতর্কিত গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন সালামসহ অন্যান্য ভাষাশহীদ ও সংগ্রামীরা। গুরুতর আহত অবস্থায় সালামকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সালামের পরিচিতদের মধ্যে এই খবর প্রথম পেয়েছিলেন সালামের ভাতিজা মকবুল আহমেদ ধনা মিয়া।
নীলক্ষেতে সালামের বাসার গৃহকর্মীর ছেলে জানিয়েছিলেন মকবুলকে যে তার চাচা মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এ খবর শুনে মকবুল দ্রুত যান তার জ্যাঠা হাবিব উল্লাহর কাছে। হাবিব উল্লাহ খবর শুনেই মকবুলসহ দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা মেডিকেলে যান। ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে তারা দেখেন পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় সালাম পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায়।
এরপর তারা চিকিৎসককে ডাকার ব্যবস্থা করলেও কোন চিকিৎসকই সাড়া দিচ্ছিল না। সন্ধ্যার সময় হাবিবুল্লাহ সালামের বাবাকে টেলিগ্রাম লিখে পাঠান তাকে জলদি ঢাকা আসতে বলে। টেলিগ্রাম পেয়েই পরদিন সকালে হাসপাতালে ছুটে আসেন সালামের বাবা ফাজিল মিয়া। সঙ্গে ছিল সালামের ছোট ভাই। সেদিন সকাল নয়টার দিকে ছাত্ররা হাসপাতালে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে সালামকে যথাযথ চিকিৎসা না দেয়ার অভিযোগে।
এর মধ্যে বেশ কয়েকবার হাবিবউল্লাহ ও মকবুল আসা যাওয়ার মধ্যে থাকলেও ছেলের পাশ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও সরেননি সালামের বাবা। আহত অবস্থায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তার বাবা। একসময় তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ২৫ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে ১১টার সময় বাবার সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন শহীদ সালাম।
২৬ ফেব্রুয়ারি শহীদ সালামের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় আজিমপুর কবস্থানে। সেখানে তার বাবা, ভাতিজা, জ্যাঠাতো ভাই ও ছোট ভাইসহ শত মানুষের উপস্থিতিতে তাকে জানাজা শেষে দাফন করা হয়। আজিমপুর পুরাতন কবরস্থানের ওজুখানার উত্তর-পূর্ব পাশের তিন নম্বর সারিতে সে সময় একটি বিশাল আমগাছ ছিল বলে জানিয়েছেন কবরস্থানের সাবেক জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মিজানুর রহমান।
যিনি ১৯৮০ সাল থেকে ওই কবরস্থানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯০ সালে সে আমগাছ কেটে ফেলা হয়। ২০১৫ সালে আবদুল করিমের সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় শহীদ সালামের কবর তখনও চিহ্নিত হয়নি। কবরের বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম আব্দুল করিমের কাছে।
তিনি বলেছিলেন, ভাইকে কবর দেওয়া হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে। তার কবরটা কোথায় আমাদের মনে নেই। আর আগে উদ্যোগও কেউ নেয়নি। এখন তো ধরেন অনেক কবর হয়েছে। একটা কবর দু’মাসও থাকে না। আগে তো মানুষও কম ছিল। কিন্তু এখন মানুষ অনেক বেশি। এক কবরের ওপর কত কবর হয়! আগে ঠিকভাবে রাখলে আজ এমনটি হতো না। আর এখন যেভাবে গুরুত্ব দিয়েছিল আগে এমনটি দিলে কবর ঠিকই থাকতো। আর তখন তো পাকিস্তান আমল, এমনিতেই সবার মধ্যে একটা ভয়। এখন যতোটা গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়, তখন তো এটা কেউ চিন্তাও করতে পারতো না।’
‘আব্বা চিনতেন। আমি নিজেও ছোটবেলায় কয়েকবার গিয়েছি। তবে পুরোপুরি মনে নেই। কবর জেয়ারতও করেছি। আব্বার সাথে ছিলাম। আমরা চারপাশে বেড়া দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তা আর থাকেনি। ভাষা আন্দোলনের ব্যাপার তো প্রথমে এমনটি ছিল না। আর তখন শহীদদের ব্যাপারে এরকম গুরুত্ব দেয়নি, ’ বলেন আব্দুল করিম।
আব্দুল করিম আরও বলেন, ‘যতোটুকু মনে পড়ে ভাইয়ের কবর ছিল ঢুকতে ডান পাশে। বরকতের কবরের পাশে। নামাজ ঘরের একপাশে। ওখানে একটি খালি জায়গা ছিল ওটার মাঝে। এক পর্যায়ে দীর্ঘ ৬৫ বছর পর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শহীদ সালামের কবরটি চিহ্নিত হয়।
তিনি বলেন, গুলিতে আহত হওয়ার চার দিন পর তার ভাই শহীদ হন। তবে ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকার ভাষাশহীদ আবদুস সালামকে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করে। সেই একুশে পদকের গেজেট প্রকাশের সময়ই ভুলবশত ২৫ ফেব্রুয়ারির বদলে লেখা হয়েছিল ৭ এপ্রিল। এরপর থেকে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। বর্তমানে প্রায় সমস্ত জায়গায় যাচাই না করে ২৫ ফেব্রুয়ারির বদলে ৭ এপ্রিল লেখা হয়। এখনও সরকারি গেজেটে আর পুনঃ সংশোধন করা হয়নি।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালের আগ পযন্ত কোথাও ভাষাশহীদ সালামের ছবি সংরক্ষিত ছিল না। বর্তমানে শহীদ আব্দুস সালামের যে ছবিটি দেখা যায় সে ছবিটি ভাস্কর রাশার উদ্যোগে চিত্রশিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছিল।
কিন্তু এই ছবি করতে গিয়েও বহু কাঠখড় পুড়তে হয়েছিল ভস্কর রাশাকে। ১৯৮৩ সালে তিনি প্রথম জানতে পারেন ভাষাশহীদ আবদুস সালামের কোন ছবি নেই। এ কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য শহীদ সালামের পরিবার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তখন তিনি যোগাযোগ করেছিলেন। তারপর থেকে তিনি চিন্তা করতে থাকেন কীভাবে শহীদ সালামের ছবি আনা যায়।
এভাবে বেশ কিছু সময় চলে যায়। ১৯৯০ সালে তার ছবি জোগাড়ের চেষ্টা অর্থনৈতিক কারণে পিছিয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে একটি প্রামাণ্য চিত্রের পরিকল্পনা করে তিনি তৎকালীন সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন ভাস্কর রাশা। তার উৎসাহ ও অর্থায়ণে ভাস্কর রাশা “অস্তিত্বের শেকড়ে আলো” শিরোনামে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে এগিয়ে এলেন। এ কাজে ভাস্কর রাশার অন্যতম সহযোগী ছিলেন সহকারী পরিচালক রানা সিদ্দিকী এবং স্থানীয় প্রতিনিধি শিমুল ও সমীর।
যোগাযোগ বিষয়ক সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান ‘স্বপ্ন দশীর’ মাধ্যমে টি, এস, সি সুইমিং পুল এলাকায় ছবি আকার অনুমতি মিলেছিল। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় এই আয়োজন করা হয়েছিল। সালামের ছবি আঁকার জন্য ভাষাশহীদ সালামের দুই ভাই ও এক বোনকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছিল। ১৯ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুইমিংপুলের পাড়ে শহীদের ভাই-বোনদের বর্ণনা শুনে ছবি আঁকা শুরু হয় এবং দিনব্যাপি এই ছবি আঁকা চলেছিলো। এ ধরনের কর্মসূচি বাংলাদেশে এটিই প্রথম ছিল। এই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন। শহীদ সালামের বোন বলকিয়ত নেছা তার ভাই শহীদ সালামের চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছিলেন- ‘আমরা ভাই বোনের মধ্যে সালামের গায়ের রঙ ছিল বেশ ফর্সা। ছোট বেলায় স্থানীয় মসজিদে পড়তে গিয়ে তিনি মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলেন ফলে তার কপাল কেটে গিয়েছিল। সেই কাটা দাগটি তার চেহারার একটি বিশেষ চিহ্ন হিসাবে থেকে যায়।’ যখন আব্দুস সালাম শহীদ হন তখন তার বয়স হয়েছিল ২৭ বছর।
শহীদ আব্দুস সালামের ভাই বোনের বর্ণনা মতে শিল্পীরা তার ছবি আঁকতে শুরু করেছিলেন। এই ছবি আঁকার অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন প্রখ্যাত শিল্পী অলোকেশ ঘোষ, আব্দুল মান্নান, শেখ আফজাল, আহমেদ সামছুদ্দোহা, শাহজাহান আহমেদ বিকাশসহ বেশ কজন শিল্পী। ওই সময় সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ছবি আঁকা চলে। ছবি আঁকা শেষ হলে শিল্পী শাহজাহান আহমেদ বিকাশের তৈলচিত্রটির সঙ্গে হুবহু সালামের চেহারার মিল পেয়েছিলেন সালামের ভাইবোনেরা। ভাষাশহীদ আব্দুস সালামের প্রতিকৃতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন তাঁরা।