কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ
দুই মাসে সাবাড় ১৬টি পাহাড় ১৫ কোটি টাকার মাটি কর্তন
রহস্যজনক ভূমিকায় পরিবেশ অধিদপ্তর
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
একের পর এক সরকারি পাহাড় কেটে নিয়ে মাটি ও বালি পাচারে ২৭টি ডাম্প ট্রাককে পরিবহনের বিশেষ ‘লাইন’ দিয়েছেন খোদ বন বিট কর্মকর্তা মাসুম মাদবর। বিট কর্মকর্তার এমন বিশেষ ‘লাইন’ নিয়ে একে একে কেটে ফেলা হয়েছে ১৬টি পাহাড়। প্রতিনিয়ত চলছে নিত্যনতুন পাহাড় কাটার ভয়াবহ কর্মযজ্ঞ। গত দুই থেকে তিন মাস ধরে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের পিএমখালী রেঞ্জের খুরুশকুল ও তোতকখালী বন বিট এলাকায় পাহাড় কাটার এমন ভয়াবহ অবস্থা চলছে। অভিযোগ রয়েছে, খোদ বিভাগীয় বন কর্মকর্তার প্রশ্রয়ে এ বন বিট কর্মকর্তা বনজ সম্পদ ধ্বংসে মেতে উঠেছেন। এর অংশ হিসেবে এ বিট কর্মকর্তাকে খুরুশকুল বিটের পাশাপাশি ২২ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে তোতকখালী বন বিটের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরও রহস্যজনক কারণে এক্ষেত্রে নীরব ভূমিকা পালন করছে। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, ‘আসলে এসব অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণ থাকলে দিন, ব্যবস্থা নেব।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজার কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘আমাদের জনবল সংকট রয়েছে। এছাড়া এভাবে পাহাড় কাটার বিষয়টি আমার জানা নেই। না জেনে আমি কিছুই বলতে পারব না।
কক্সবাজারভিত্তিক পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের দেয়া তথ্য মতে, খুরুশকুল ইউনিয়নের পূর্ব হামজারডেইল, কদমতলী ও বামনাকাটায় পাঁচটি পাহাড় কেটে নিচ্ছেন আবছার, গিয়াস, নবাব মিয়া, রুনো, জয়নাল, ফজুসিকদারপাড়া, জলিয়াবাপেরপাড়া ও কুমারিয়াছড়ায় তিনটি পাহাড় কাটছেন মামুন ও কায়ছার, তেতৈয়ার ইউসুফফকির পাড়ায় দুটি কাটছেন হেলাল, সওদাগরপাড়া ও সিকদারপাড়ায় তিনটি পাহাড় কেটে নিচ্ছেন বেলাল সিকদার ও নাছির এবং তোতকখালী ও সতেরকাটায় তিনটি সরকারি পাহাড় কেটে নিচ্ছেন মামুন, কাদের, ধলু, আজিম ও বাবুল।
সংগঠনটির দেয়া তথ্য বলছে, গত দুই মাসে ১৬টি পাহাড় থেকে আনুমানিক ৭ কোটি ঘনফুট মাটি ও বালি পাচার করা হয়েছে। এসব মাটি ও বালির বাজারমূল্য আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা।
সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, ‘জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী খুরুশকুল ও তোতকখালী বন বিট এলাকা ঘুরে প্রকাশ্যে পাহাড় কাটার ভয়াবহ চিত্র দেখা গেছে। অবস্থা দেখলে মনে হবে, সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোনো তৎপরতা নেই। এভাবে চলতে থাকলে উক্ত এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয় ঘটতে পারে।’ সংকট উত্তরণে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
গত শুক্রবার ও শনিবার সরেজমিন ঘুরে ১৬টি পাহাড় কাটার সত্যতা পাওয়া গেছে। এলাকাবাসী বলেছেন, ১৬টি পাহাড় কেটে ২৭টি ডাম্প ট্রাক যোগে দিনে-রাতে মাটি ও বালি পাচার করা হচ্ছে। এসব মাটি ও বালি বিক্রি করা হয় প্রতি গাড়ি ৯০০ টাকা থেকে ৪ হাজার টাকা পর্যন্ত। এলাকাবাসী আরো জানান, পাহাড় কর্তনকারীরা অনেকটা প্রভাবশালী এবং সন্ত্রাসী প্রকৃতির। তাদের ভয়ে স্থানীয় সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করার সাহস করে না। এমনকি বন বিভাগ, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেও এক্ষেত্রে তেমন পদক্ষেপ নিতে দেখা যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করেই প্রকাশ্যে দিনে-রাতে পাহাড় কেটে বালি ও মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। যার কারণে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা, গাড়ি জব্দ এবং পাহাড় কাটা বন্ধে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করে না বন বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর। শুধুমাত্র দৈনিক ও মাসিক টাকা না দিলেই দুয়েকটি মামলা ও গাড়ি জব্দ দেখানো হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ডাম্প ট্রাক মালিক জানান, প্রতি ডাম্প ট্রাক দিনে ১ হাজার টাকা এবং রাতে ১ হাজার টাকা হারে বন বিট কর্মকর্তা মাসুম মাদবরকে দিতে হয়। এভাবে ২৭টি ডাম্প ট্রাক থেকে দিনে-রাতে ৫৪ হাজার টাকা নেন মাসুম মাদবর। সেই টাকা সদর রেঞ্জ হয়ে বিভাগীয় বন কর্মকর্তা পর্যন্ত দেয়া হয় বলে তিনি জানান, যার কারণে এভাবে অপরাধ করেও প্রকাশ্যে দুটি বন বিটে পাহাড় কাটার মচ্ছব চলছে। ওই ডাম্প ট্রাক মালিক আরো জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরকে দৈনিক টাকা দিতে না হলেও অভিযান এবং মামলা না করার শর্তে কিছু দিন পর পর মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। এক ব্যক্তি পরিবেশ অধিদপ্তরের নাম দিয়ে ওই টাকা গ্রহণ করেন। অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে খুরুশকুল বন বিট কর্মকর্তা মাসুম মাদবর বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমাদের মধ্যে অনেকেই আমার নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এছাড়া আমি দিনে-রাতে পাহারা দিচ্ছি। এরপরও হয়তো কেউ কেউ চুরি করে মাঝেমধ্যে কয়েকটি গাড়ি চালায়। এখন আগের মতো গাড়ি চলে না।
পিএমখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ বাবুল বলেন, ‘মাসুম মাদবরের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়, তবে কেউ লিখিত অভিযোগ না করলে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয় না। এছাড়া আমাদের জনবলসহ নানা সংকট রয়েছে। পাহাড় কাটা বন্ধে ইউএনও এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে লিখিত আকারে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে।