কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের পশ্চিম গোমাতলী হান্নান মিয়ার ঘোনা নামক স্থানে উপকূলীয় বন বিভাগের আওতাধীন প্রায় ২০০ একর ম্যানগ্রোভ অরণ্য দখল করে চিংড়ি ঘের তৈরির মহোৎসব চলছে। মাস খানেক ধরে এই প্যারাবন ধ্বংসযজ্ঞ ও বাধ দিয়ে ঘের তৈরি করে আসলেও উপকূলীয় বন বিভাগের রহস্যজনক ভূমিকায় ভাবিয়ে তুলছে পরিবেশবাদীদের। স্থানীয়দের তোপের মুখে গত বৃহস্পতিবার স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপকূলীয় বনবিভাগ সরেজমিন গিয়ে দায় সেরেছেন বলে জানা গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য, খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের মহেশখালী গোরাকঘাটা রেঞ্জের অধিনে চৌফলদন্ডী বিট অফিসের আওতাধীন পোকখালী ৬নং স্লুইস গেটস্থ হান্নান মিয়ার ঘোনা নামক ঘেরের পশ্চিমে প্রায় ২০০ একর জায়গা দখল করে বাঁধ দিয়ে চতুর্দিকে ঘেরাও করে রেখেছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। এ দখল যজ্ঞে কেটে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার বাইন, কেওড়াসহ হরেক প্রজাতির গাছগাছালি। পরিবেশ প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি আবাসস্থল হারাচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্যে আশ্রয় নেয়া নানান প্রজাতির প্রাণী।
সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখা যায়, হান্নান মিয়ার ঘোনার পশ্চিমে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে মহেশখালী চ্যানেলের সাগরের একটু পূর্বে শত শত শ্রমিক দিয়ে মাটি কেটে বাঁধ তৈরি করছে। চারপাশে দেশি-বিদেশি অস্ত্র দিয়ে পাহারা বসিয়ে বিভিন্ন এলাকার প্রায় অর্ধ শতাধিক সন্ত্রাসী। গণমাধ্যম, বন বিভাগ, পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ অন্যন্যা সংস্থার লোকজন ঘটনাস্থলে গেলে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা এগিয়ে এসে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে বলে জানান কয়েকজন সাংবাদিক। ঘটনাস্থল সাগরের পাশাপাশি হওয়ায় দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে যেতে দুরূহ হওয়ায় সহজে কেউ যেতে চায় না। সেটিকে পুঁজি করে হরহামেশাই দখল যজ্ঞ চলমান রেখেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গোমাতলী এবং চরপাড়ার প্রায় ২০০ পরিবার থেকে ২০০ জনকে সদস্য করে গোষ্ঠীভিত্তিক পৃথক পৃথক সমিতি গঠন করে, এসব সংগঠনের প্রতিটি সদস্য থেকে তোলা হয়েছে নির্দিষ্ট হারে চাঁদা। এ টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে সরকারি কোটি কোটি টাকার জমি দখলে। তাদের সাথে রয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা, সামাজিক ব্যক্তি, প্রবাসী, ব্যবসায়ী, শ্রমিকসহ নানা শ্রেণির মানুষ। স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি জানান, খবর পেয়ে চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গেছে, কিন্তু কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়নি। গুঞ্জন উঠেছে বিট কর্মকর্তাকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে এসব বন সম্পদ দখল করে আসছে দখলবাজরা। বিষয়টি ব্যাপক জানাজানি এবং গণমাধ্যম কর্মীদের নজরে আসলে জনরোষের পড়ার শঙ্কায় ১ লাখ টাকা ফেরতও প্রদান করেন বিট কর্মকর্তা।
পরিবেশবিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপল এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, সিন্ডিকেট সরকারি সম্পদ দখল করতে পারে না। ম্যানগ্রোভ অরণ্যে নানান প্রজাতির পশু পাখি, প্রাণী, গাছগাছালি রয়েছে। বন্যপ্রাণী, মৎস্য, পরিবেশ, জলাধার আইন লঙ্ঘন করে যারা এ সব ধ্বংসযজ্ঞে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বন বিভাগ যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে। সেক্ষেত্রে সকল শ্রেণির মানুষ এবং জেলা, উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে উপকূলীয় বন বিভাগের গোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. আইয়ুব আলীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, খবর পেয়ে গত বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়েছে। ওখানে এখনো গাছ কাটা হয়নি। তবে কয়েকটি বাঁধ কেটে দেয়া হয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে জানান তিনি।
আর্থিক লেনদেনসহ সামগ্রিকবিষয় নিয়ে কথা হয় চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি অর্থ লেনদেনের বিষয়টি সত্য নয় দাবি করে বলেন, যে পরিমাণ জায়গা বলা হচ্ছে আসলে এতটুকু নয়। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বোট যোগে ঘটনাস্থলে যাওয়া হয়েছিল, সেখানে প্যারাবন নিধন করে ঘের তৈরির মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তিনি আরো বলেন, স্থানীয় কিছু জেলে সাগরের মাছ শিকার করতে ১৬০ ফিট মতো চর দখল করেছিল, সেটি কেটে দেয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা করা হবে বলে জানান বন বিভাগের এ কর্মকর্তা।
স্থানীয়রা জানান, চৌফলদন্ডী বিট কর্মকর্তার সাইফুল ইসলামের রহস্যজনক ভূমিকার কারণে দখলবাজরা দিনদিন বেপরোয়া গতিতে অস্ত্রের মহড়ায় সরকারের কোটি কোটি টাকার উপকূলীয় বনভূমি দখলে নিচ্ছে। তারা উপকূলীয় বন সম্পদ দখলকারী এবং অসাধু বন কর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও স্থানীয় সংবাদকর্মী এবং পরিবেশকর্মীদের মারফত খবর পেয়ে গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন ঈদগাঁও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুবল চাকমা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজারের উপ-পরিচালক নুরুল আমিন জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে গত বৃহস্পতিবার পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে, এখনো রিপোর্ট পেশ করেনি পরিদর্শন টিম। রিপোর্ট পেশ করলে বিস্তারিত জানানো হবে এবং পরিবেশ ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান এ কর্মকর্তা।