হারিয়ে যাচ্ছে সুস্বাদু হাতে ভাজা মুড়ি
প্রকাশ : ০২ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফকির শহিদুল ইসলাম, খুলনা
রমজান মাসে মুড়ি ছাড়া বাঙালির ইফতার কল্পনা করা যায় না। ইফতারে অন্য আইটেমের কমতি থাকলেও মুড়ি থাকা চাই। কিন্তু বর্তমানে হাতে ভাজা মুড়ির বাজার চলে গেছে কল কারখানার দখলে। আধুনিক জীবনযাত্রা আর পরিবর্তনের ছোঁয়ায় মান্ধাতার আমলের ঐতিহ্য হাতে ভাজা দেশি মুড়ি খুলনা থেকে বিলুপ্তির পথে। যান্ত্রিক ব্যবস্থার যাঁতাকলে আর কালের বিবর্তনে হাতে ভাজা মুড়িশিল্প আজ আর গ্রামের পল্লি প্রান্তরে দেখা যায় না। পবিত্র মাহে রমজান সমাগত। মাহে রমজানে মুড়ি ছাড়া ইফতার যেন অকল্পনীয়। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে নানা খাবারের সঙ্গে এখনো ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে মুড়ির কদর। হাতে ভাজা মুড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে কারখানার মেশিনের তৈরি মুড়ি। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খাবারের কথা যদি আসে, তাহলে মুড়ির জুড়ি নেই। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে উৎসব পার্বণেও মুড়ি দেশের মানুষের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলেছে মুড়ির বৈশিষ্ট্যও। একসময় মায়েদের হাতে ভাজা মুড়ি ছিল একমাত্র ভরসা। স্বাদে ও গুণে এর তুলনা মেলা ভার। চাল সংগ্রহ করে পানিতে ভিজিয়ে লবণ দিয়ে রোদে শুকিয়ে চুলায় ঘামিয়ে তৈরি করা হয় মুড়ির চাল। এরপর সেই চাল দিয়ে তৈরি করা হয় হাতে ভাজা দেশি মুড়ি।
মুড়ি ভাজা ছেড়ে দেওয়া ডুমুরিয়ার দিলিপ কুমার বলেন, এক মণ পরিমাণের চালের মুড়ি তৈরি করতে ৬-৭ ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়। বর্তমানে ধানের দাম বৃদ্ধি, পোড়ানোর কাজে ব্যবহৃত লাকড়ি ক্রয় ছাড়াও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে প্রতি কেজি মুড়ি উৎপাদনে গড়ে খরচ হয় প্রায় ৭৫-৮০ টাকা। হাতে তৈরি মুড়ির রং লালচে হলেও খেতে সুস্বাদু হয়। এছাড়া ২০ থেকে ২৫ দিন ঘরে রাখলেও এর স্বাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। তিনি আরও বলেন, দেশে গড়ে ওঠা মুড়ি কারখানায় মুড়ি তৈরি হওয়ায় এখন হাতে তৈরি মুড়ি শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। কারখানায় তৈরি মুড়ি দেখতে সাদা ধবধবে হলেও ২ দিন ঘরে রাখলেই চুপসে যায়। এসব মুড়ি খোলা অবস্থায় প্রতি কেজি ৮০-৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাতগুলো ১২০ টাকায় পাওয়া যায়। যা হাতে তৈরি মুড়ির দামের চেয়ে কম। তাই হাতে ভাজা মুড়ি বিক্রির ক্ষেত্রে লাভ তো দূরের কথা আসল দামই তুলতে পারেন না মুড়ির কারিগররা। মুড়ি শিল্পের সাথে জড়িত কারিগরদের দাবি সরকার যদি এই শিল্প বাচাঁতে এগিয়ে আসে তাহলে তাদের জীবিকা রক্ষা পাবে। কারিগরদের সরকারি ভাতা বা অনুদান দিয়ে হাতে ভাজা মুড়ি সবাইকে ক্রয় করতে উৎসাহ্ দিতে হবে এমনটাই দাবি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার নয়টি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে হাতে ভাজা এই মুড়ির বাজার পুরোপুরি আধুনিক কলকারখানার দখলে। তাই শহর, উপশহর আর গ্রাম অঞ্চলে মানুষের কাছে মুড়ির কদর থাকলেও হাতে ভাজা মুড়ি মেলে না। শহরের সীমানা ছাড়িয়ে পল্লি গাঁয়ের বিভিন্ন বাড়িতেও কারখানার মুড়ির দখল। অথচ আগেকার দিনে গ্রামের ছোট-বড় যেকোনো পরিবারে সারা বছরই হাতে ভাজা মুড়ি পাওয়া যেত। কালের পরিক্রমায় আধুনিক সমাজব্যবস্থায় খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু কারখানায় মুড়ি উৎপাদিত হওয়ায় হারিয়ে গেছে সুস্বাদু হাতে ভাজা দেশি মুড়ি। শুধু তা-ই নয়, দেশের বড় বড় নামীদামি কোম্পানিগুলোও মুড়ি তৈরি করে শহর থেকে শুরু করে গ্রামের ছোটোখাটো দোকানগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছে। ফলে এ শিল্প আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। অথচ হাতে ভাঁজা মুড়ি আমাদের গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্য। এটা এক ধরনের শিল্প। কিন্তু আমাদের এই পুরোনো ঐতিহ্য আর শিল্পটি এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে হাতে ভাঁজা মুড়ির সঙ্গে বর্তমানে কারখানায় তৈরি বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট মুড়ির তুলনা চলে না। স্বাদে গন্ধে হাতে ভাঁজা মুড়ি সত্যি অতুলনীয়। বিশেষ করে মুসলিম ধর্মীয় পর্বে ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিভিন্ন পূজা পার্বনের আগেই গ্রামের প্রতিটি পরিবারে দেখা যেত হাতে ভাঁজা দেশীয় মুড়ি তৈরির চিত্র। যার স্বাদ গন্ধ ছিল অতুলনীয়। তবে বর্তমানে বিভিন্ন কলকারখানায় মুড়ি সাদা করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ইউরিয়া সার। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য হাতে ভাজা দেশীয় মুড়ি।