নদীভাঙনে নিজের মাথাগোঁজার শেষ সম্বল হারিয়ে ফেনী আসেন কৃষক আছমত আলী। নতুন জেলায় এসে শুরুতে রিকশা চালিয়ে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ করলেও সেখানে তেমন সফলতা পাননি। এরপর কৃষি বিভাগের সহায়তায় শুরু করেন কুল চাষ। এতে কয়েক বছরের মধ্যে মাথাগোঁজার ঠাঁই পান তিনি। বর্তমানে আছমত আলী ফেনী সদর উপজেলার পূর্ব ফলেশ্বর আলী আজ্জম ইটভাটা সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করছেন। পরিবারে তার চার ছেলে ও এক কন্যাসন্তান রয়েছে। কুল চাষের শুরুর পথচলা তুলে ধরে কৃষক আছমত আলী বলেন, লক্ষ্মীপুরের রামগতি থেকে ফেনীতে এসে প্রথমে রিকশা চালিয়েছি। তখন ছোট পরিসরে শাকসবজি আবাদ করতাম। শাকসবজি চাষে তেমন সফলতা পাইনি। পরবর্তী সময়ে কৃষি বিভাগের পরামর্শে ৩ বছর আগে ৪০ শতক জায়গায় রাজশাহী থেকে চারা এনে কুল চাষ শুরু করি। সফলতা পেয়ে পরে খুলনা থেকে চারা এনে আরও ২০ শতক জায়গায় আরেকটি বাগান করেছি। কৃষক আছমত আলী বলেন, প্রথমে করা বাগানে ১০০ চারা লাগালেও কিছুদিন পর প্রায় অর্ধেকের মতো চারা তুলে বাগান ফাঁকা করা হয়েছে। বর্তমানে বাগানে দেড় শতাধিক গাছ রয়েছে। গাছের দূরত্ব কম হলে ফল নষ্ট হয়ে যায়। ফাঁকা রাখলে ফলনও ভালো হয়। তিনি আরো বলেন, বল সুন্দরী জাতের কুল চাষে বেশি সফলতা পেয়েছি। এ জাতের বরই অনেক সুস্বাদু। ফলনও এখন পর্যন্ত আশানুরূপ পাচ্ছি। বর্তমানে দুটি বাগানে বল সুন্দরী ও কাশ্মীরি বাউকুল আছে। এখন বাগান থেকে দৈনিক ২০ থেকে ২৫ কেজির মতো বরই বিক্রি হয়। কেজি প্রতি ১০০ টাকা করে এলাকার মানুষ বাগান থেকে এসে পছন্দের বরই কিনতে পেরে খুশি। চলতি মৌসুমে বাগান থেকে প্রায় ২ লাখ টাকার মতো কুল বিক্রি করতে পারবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। সমন্বিত চাষ পদ্ধতি নিয়ে আছমত আলী বলেন, দুয়েক মাস ছাড়া বছরের পুরো সময়েই কুল চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন সবজি আবাদ করি। এখনো কুল বাগানে আদা ও হলুদ রয়েছে। এছাড়া বছরজুড়ে অন্যান্য ফসলের মতো কুল চাষে খুব বেশি পুঁজি দিতে হয় না। এজন্য লাভ ভালো থাকে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, পোকা ও পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষায় বাগানের চারপাশে মশারি জালের বেড়া দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি গাছের থোকায় থোকায় ঝুলছে লাল-সবুজ রঙের কুল। কুলের ভারে মাটিতে নুয়ে পড়েছে গাছের ডাল। সুস্বাদু বাহারি রঙের কুল নিজেই গাছে থেকে পাড়ছেন কৃষক আছমত আলী। কৃষক আছমত আলীর বড় ছেলে মো. বেলাল বলেন, নদী ভাঙনে বাড়িঘর হারিয়ে লক্ষ্মীপুর থেকে আমরা ফেনী চলে আসি। তখন রিকশা চালিয়ে বাবা আমাদের অনেক কষ্ট করে বড় করেছেন। বাবা বিভিন্ন শাকসবজি আবাদ করলেও তেমন সফলতা মেলেনি। পরে এই কুল বাগান করে আমাদের পরিবারে সুদিন ফিরেছে। এখন প্রতি বছর দুটি বাগান থেকে ২ লাখ টাকার বেশি আয় হয়। মো. আমজাদ নামে এক ক্রেতা বলেন, ভেজালমুক্ত কুল কিনতে এখানে এসেছি। বাগানে উৎপাদিত কুল কিনতে মানুষের আগ্রহ বেশি। সচরাচর এভাবে সরাসরি বাগান থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। তাই এখানে এসেছি। মো. সজীব উদ্দিন নামে আরেক ক্রেতা বলেন, এখানে এসে নিজেই গাছ থেকে পছন্দের কুল পেরে বাড়ি নিচ্ছি। বাজারে কিনতে গেলে ভেজাল নিয়ে শঙ্কার মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু এখানে ভেজালমুক্ত কুল কিনতে পারছি। বিজয় নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, এ উদ্যোগ আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। বিশেষ করে তরুণদের আত্মকর্মসংস্থানের উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এখানে এসে বাগানের মালিক থেকে কুল চাষের বিষয়ে ধারণা নিচ্ছি। সুযোগ হলে ভবিষ্যতে এমন উদ্যোগ বাস্তবায়নের ইচ্ছে আছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে জেলায় ৯০ হেক্টর জমিতে কুলের আবাদ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ৮০ মেট্রিক টন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় কুলের আবাদ হয়েছিল ৮৬ হেক্টর জমিতে। ফলন হয়েছিল ৯৩৮ মেট্রিক টন। সদর উপজেলার কাজীরবাগ ইউনিয়নে দায়িত্বরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, কৃষি বিভাগ সবসময় চাষির পাশে থেকে কাজ করছে। বিভিন্ন রোগবালাই প্রতিরোধে এবং বাগান পরিচর্যা বিষয়ে পরামর্শসহ দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই জমিতে তিনি (আছমত আলী) কুল চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন শীতকালীন সবজিও আবাদ করছেন। এতে বাড়তি লাভবান হচ্ছেন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মো. জগলুল হায়দার বলেন, ফেনীর মাটি ও সামগ্রিক পরিবেশ কুলের আবাদের জন্য ইতিবাচক। আগামীতে এ জেলায় কুলের আবাদ আরও বাড়তে পারে। এটি এ জনপদের জন্য আশার আলো। কুল চাষে কৃষক যে লাভ পাচ্ছে তাতে সে যেমন লাভবান হবে তেমনি দেশও লাভবান হবে। পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। পাশাপাশি দেশ বাণিজ্যিক কৃষিতে এগিয়ে যাবে।