কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিম মরিচ্যা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবুল কাশেমের বাড়িটি একে বারে নীরব। গতকাল সকাল ৮টায় বাড়ির সামনে বসা ছিলেন এই বৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ির ওঠানে সারিবদ্ধ চেয়ার বসানো। গ্রামের মানুষের কিছু আনাগোনা রয়েছে। বাড়ির একটু দূরে পশ্চিম মরিচ্যা জামে মসজিদের পাশের কবর স্থানে তৈরি করা হচ্ছে ৩টি কবর। যেখানে শায়িত করা হবে বীর মুক্তিযোদ্ধার ছেলে কাস্টমস কর্মকর্তা, তার স্ত্রী ও কন্যাকে। যারা রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ ভবনে লাগা আগুনে মারা গেছেন।
এরা হলেন, কাস্টমস ইন্সপেক্টর শাহ জালাল উদ্দিন (৩৫), তার স্ত্রী মেহেরুন নেসা হেলালী (২৪) এবং তাদের মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিলা (৪)। গতকাল সকাল সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে মরদেহ ৩টি লাশ গ্রহণ করেছেন নিহত শাহ জালাল উদ্দিনের বড় ভাই হলদিয়াপালং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ জাহান সাজু। সন্তান হারিয়ে অনেকটা নির্বাক মুক্তিযোদ্ধা পিতা। তিনি কথা বলতেও পারছেন না।
নিহতের মামাত ভাই স্কুল শিক্ষক জামাল উদ্দিন জানান, ৫ ভাই এক বোনের মধ্যে শাহ জালাল উদ্দিন তৃতীয়। তিনি ২০১৭ সালে কাস্টমসের চাকরিতে যোগদান করেন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ জেলার পানগাঁও কাস্টমস অফিসে কর্মরত ছিলেন তিনি। প্রতিদিন পিতার সাথে ৩-৪ বার ফোনে কথা বলতেন। বৃদ্ধ পিতার চিকিৎসা ওষুধ সেবনের জন্য তাড়া দিতেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার পর পিতার সাথে সর্বশেষ কথা বলেছিলেন শাহ জালাল উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘শাহ জালাল উদ্দিন পিতাকে জানিয়ে ছিলেন, টানা ৩ দিনের ছুটি পাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে খাগড়াছড়ি ভ্রমণে যাচ্ছেন। ঢাকায় শ্যালিকার মেডিকেল কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছেন। তাদের সঙ্গে দেখা করেই বাসে উঠে যাত্রা দেবেন।
এরপর থেকে আর কোনো ফোন পাননি পিতা। পিতা ধারণা করেছিলেন ছেলে, বউ, নাতিনীকে নিয়ে খাগড়াছড়ি গেছেন। কথাগুলো বলেন, শাহ জালাল উদ্দিনের ছোট্ট ভাই হাশেম বিন লিনকন।
তিনি বলেন, বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর কক্সবাজার কাস্টমস অফিসের ভাইয়ের এক সহকর্মী ফোন করে জানান ফেসবুকে অজ্ঞাত পরিচয়ে যে কয়েকজনের মরদেহ দেখা যাচ্ছে, যেখানে ভাবী ও মেয়ের ছবি দেখা যাচ্ছে। ভাইয়ের বিষয়টি জানেন না। তারপর থেকে পরিবারের পক্ষে যোগাযোগ করার পর গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে ভাবীর বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোক্তার হোসেন হেলালী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের মর্গে গিয়ে ৩ জনের মরদেহ শনাক্ত করেন। এরপর প্রশাসনিকভাবে মরদেহ হস্তান্তর করতে আইনগত বিষয় থাকায় রাতে ভাই (সাজু) ঢাকা পৌঁছে মরদেহ গ্রহণ করছেন।
একমাত্র বোন তসলিমা আকতার বলেন, ভাইদের মধ্যে অনেকটা পিতার ভূমিকা পালন করতেন শাহজালাল। প্রতিনিয়ত ফোন করে খোঁজখবর নিতেন। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও ফোন করে কিছু লাগবে কি না জানতে চেয়েছিলেন। এখন ভাই নেই.... মামাত ভাই স্কুল শিক্ষক জামাল উদ্দিন আরো জানান, আজ রোববার সকাল ১২টায় মরিচ্যা মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতি বালিকা বিদ্যালয়ের মাঠে নামাজে জানাজার শেষে মরিচ্যা জামে মসজিদ সংলগ্ন কবর স্থানে দাফন সম্পন্ন করা হবে।
নিহতের স্কুল জীবনের বন্ধু কৃষি কর্মকর্তা এ এইচ জুনায়েদ জানান, শাহ জালাল ৩৫তম বিসিএস (নন ক্যডার) সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (ব্যাচ ১৭) হিসেবে কাস্টম এক্সাইজ ও ভ্যাট নারায়ণগঞ্জ অফিসে কর্মরত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে তারা বেইলি রোডের ‘কাচ্চি ভাই’ রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে যান। এসময় অগ্নিকাণ্ডে স্ত্রী ও সন্তানসহ তার মৃত্যু হয়।
তিনি আরো জানান, শাহ জালাল এলাকায় ‘শান্ত ছেলে হিসাবে পরিচিত’। ‘বন্ধুখ্যাত একজন মানুষ ছিলেন’। নিয়মিত বন্ধুদের খোঁজখবর নিতেন। সুখে-দুঃখে বন্ধুদের পাশে থাকতেন। তার দেয়া তথ্য মতে, শাহ জালাল গত কয়েকদিন আগেও বন্ধুদের গ্রুপে ভয়েজ দেয়। ঈদের ছুটিতে আসলে বন্ধুদের নিয়ে মিলন মেলার আয়োজন করার প্রত্যাশা ছিল তার।