সুসংবাদ প্রতিদিন

বিশ্ববাজারে যাবে শেরপুরের জামাই আদুরে চাল

প্রকাশ : ০৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

বিশ্ববাজারে যাবে শেরপুরের ‘জামাই আদুরে চাল’। স্থানীয়রা জানান, আমন মৌসুমের চাল তুলশীমালা যা আঞ্চলিকভাবে জামাই আদুরে চাল নামে খ্যাতি অর্জন করেছে। সুগন্ধি ও আকারে ছোট হওয়ায় পোলাও, বিরিয়ানি ও পায়েস রান্নায় এ চালের জুড়ি মেলা ভার। অন্যদিকে জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, তুলশীমালা চাল দেশবিদেশে ছড়িয়ে দিতে বিশাল বাজেট তৈরি করা হয়েছে। এতে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। এরই মধ্যে সে অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে পার্টনার প্রজেক্ট। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও অন্য একাধিক সূত্র জানায়, জেলার সদর উপজেলাসহ নকলা, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী জুড়ে তুলশীমালা ধান উৎপাদন হয়। এটি আলোকসংবেদনশীল আমন প্রজাতির খরাসহিষ্ণু ধান। ধানের রং সাধারণত কালচে ধূসর। তবে এই ধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধানের ফুল আসার পর থেকে পাকা পর্যন্ত পাঁচবার রং পাল্টায়। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এ ধান রোপণ করা হয়। আর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত চলে ধান সংগ্রহ করার কাজ। বছরে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিকটন তুলশীমালা ধান পাওয়া যায়। আর এ থেকে চাল উৎপাদন হয় অন্তত ১৩ হাজার মেট্রিকটন। এছাড়া সারা দেশে ২৫-৩০ হাজার হেক্টর জমিতে তুলশীমালা ধানের চাষ হয়। এর শতকরা ৫০ ভাগই আবাদ হয় শেরপুরে। তুলশীমালা ধান উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত জেলার ১১ হাজার ৭৯৯ জন কৃষকের একটি ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ধানের উৎপাদন আরো বাড়াতে কৃষকদের নানাভাবে পরামর্শ ও সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। নালিতাবাড়ীর রূপনারায়ণকুঁড়া এলাকার কৃষক মোজাম্মেল হোসেন বলেন, এক একর জমিতে তুলশীমালা ধান চাষ করতে খরচ হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ধান পাওয়া যায় ৩০ থেকে ৩৫ মণ। প্রতিমণ ধানের দাম প্রকারভেদে ২১০০ থেকে ২২০০ টাকা। চাষাবাদসহ বিভিন্ন ধরনের খরচ বাদ দিয়ে প্রতি একরে কৃষকের লাভ থাকে ৪০-৪৫ হাজার টাকা। ঝিনাইগাতীর আয়নাপুর গ্রামের কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, একসময় শেরপুরে কালিজিরা, চিনিগুঁড়া, তুলশীমালাসহ বেশ কিছু জাতের চিকন ধান ব্যাপক পরিসরে আবাদ হতো। পর্যায়ক্রমে বাজারে নানা জাতের উচ্চফলনশীল ধান আসার পর মাঝে কয়েক বছর চিকন ধানের চাষ কিছুটা কমে যায়। তবে তুলশীমালা তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়। অতিথি আপ্যায়নে তুলশীমালা ধানের চালের বেশ কদর রয়েছে। দিন দিন এর চাহিদা বাড়ছে। তাই তুলশীমালা ধান চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকের। শেরপুর সদর উপজেলার ভীমগঞ্জ এলাকার কৃষক তোফাজ্জল মিয়া বলেন, প্রথম দিকে ধানের বাজারদর কম থাকলেও বর্তমানে তুলশীমালার বাজারমূল্য বেড়েছে। এবারের মৌসুমে ধানের ভালো ফলন পেয়েছি, একরপ্রতি প্রায় ৩৫ মণ ধান পাওয়া গেছে। গৃহবধূ মনিকা রায় টুকি বলেন, বাড়িতে জামাই এলে তুলশীমালা চাল ছাড়া আপ্যায়ন কল্পনাও করা যায় না। পোলাও, বিরিয়ানি ও পায়েস রান্নায় তুলশীমালা চাল ব্যবহার করা হয়। এই চাল যেহেতু জামাই আপ্যায়নে ব্যবহৃত হয়, তাই আমরা একে জামাই আদুরে চাল বলেই জানি। পারিবারিক প্রয়োজনে প্রতিবছর সীমিত আকারে তুলশীমালা ধান চাষ করলেও সামনের বছর বিক্রির জন্য আরও বেশি চাষ করার ইচ্ছা আছে আমাদের। পুষ্টিবিদ রীতা খানম বলেন, তুলশীমালা চাল চিকন ও সুগন্ধি। এতে রয়েছে উচ্চ গুণসম্পন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজসমৃদ্ধ। ঈদ, পূজাপার্বণ, বিয়ে, বউভাতসহ বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে পোলাও, বিরিয়ানি ও মিষ্টান্ন তৈরিতে এ চালের জুড়ি নেই। এদিকে জেলা শহরের নয়আনী বাজারের খুচরা চাল ব্যবসায়ী আব্দুর রহমান বলেন, বর্তমানে প্রতি কেজি তুলশীমালা চাল ১১০-৪০ টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। চালকল মালিক শামীম হোসেন বলেন, প্রতিবছর জেলায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার তুলশীমালা চাল বেচাকেনা হয়। চালকল মালিক ছাড়াও অনলাইন বা ই-কমার্সের মাধ্যমেও তরুণ উদ্যোক্তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় তুলশীমালা চাল বিক্রি ও সরবরাহ করছেন। তাদের একজন হলেন শেরপুর শহরের নবীনগর এলাকার মনজিলা মিরা। ২০২০ সালের জুন মাসে করোনাকালে তিনি ‘তুলশীমালা এক্সপ্রেস’ নামের ফেসবুক ভিত্তিক একটি গ্রুপ খোলেন। এরপর থেকে অনলাইনে অর্ডার নিয়ে ভোক্তাদের কাছে তুলশীমালা চাল পৌঁছে দিচ্ছেন। মনজিলা মিরা বলেন, শেরপুর জেলার ব্র্যান্ডিং নির্ধারণ করা হয় পর্যটন খাত এবং একটি ধানের নামে, যে ধানের নাম তুলশীমালা। এ সম্পর্কে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সুকল্প দাস বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের ভৌগোলিক নির্দেশক ইউনিট তুলশীমালা ধানকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়া এই পণ্যটি বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এর অনুমোদনও পেয়েছে। ড. সুকল্প দাস আরো বলেন, তুলশীমালা চাল দেশবিদেশে ছড়িয়ে দিতে একটি বিশাল বাজেট তৈরি করা হয়েছে। এতে অর্থায়ন করবে বিশ্বব্যাংক। এরই মধ্যে সে অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদন হয়েছে। এর নাম দেয়া হয়েছে পার্টনার প্রজেক্ট। এ লক্ষ্যে জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায় প্যাকিং হাউজ এবং কালেকশন পয়েন্ট করা হবে। শুধু তাই না তুলশীমালাকে নিয়ে আরো বিস্তৃত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে যা চলতি বছরই বাস্তবায়ন করা হবে।