ঢাকা ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চট্টগ্রামে খেজুরসহ আমদানি ফলের দাম বেড়েছে

চট্টগ্রামে খেজুরসহ আমদানি ফলের দাম বেড়েছে

চট্টগ্রামে খেজুরসহ রমজানের অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। রমজান ঘনিয়ে আসার সাথে দাম আরো বাড়বে বলে ক্রেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বন্দর দিয়ে আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ ক্রেতারা। তারা এখনই বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি বাজারে অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন। জানা গেছে, বন্দর দিয়ে ছয় মাসে প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন খেজুর আমদানি হয়েছে। তিন মাসে তাজা ফল আমদানি হয়েছে ৭৩ হাজার ৪৮৪ মেট্রিক টন। রমজানের আগে আমদানি বাড়লেও দাম কমেনি। খেজুর সহ সব ধরনের আমদানি ফলের দাম দফায় দাফায় বাড়ছে। খেজুরের দাম পাইকারি-খুচরা দুই পর্যায়েই বেড়েছে। রোজায় চাহিদা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে খেজুরের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে বলে জানান খোদ ব্যবসায়ীরা। পাইকাররা বলছেন, আমদানিকারকদের কাছ থেকে বেশি দামে খেজুর সহ নানা ধরনের ফল ক্রয় করতে হচ্ছে। তারা দাম বেশি নিলে আমাদেরও খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে দাম বেশি নিতে হচ্ছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারদের কাছ থেকে বেশি দামে কেনা খেজুর সহ আমদানি ফল কম দামে বিক্রির সুযোগ নেই।

পাইকারদের আড়ত ও খুচরা ব্যবসায়ীদের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের ফলের দাম বাড়তি। খেজুরের দাম কেবল বাড়ছেই। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রোজাকে কেন্দ্র করে দাম আরো বাড়বে। আপেল, মাল্টা, আঙ্গুর, আনার, নাশপাতির দাম বেড়েই চলেছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পর্যাপ্ত আমদানি হয়েছে। এরপরও দাম বাড়ছে লাফিয়ে। ক্রেতাদের দাবি কারসাজির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হচ্ছে। তবে আমদানিকারকরা বরাবরের মতো দাবি করছেন, আমদানি কম। বিশেষ করে খেজুরের শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা দেয়া হলে এনবিআরের অসহযোগিতার কারণে বাস্তবে কোন সুফল মিলছে না। তাই এই মুহূর্তে খেজুরের দাম কমছে না।

চট্টগ্রাম বন্দর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ছয় মাসে খেজুর আমদানি হয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে গেল ফেব্রুয়ারি এক মাসে আমদানি হয়েছে ২৭ হাজার মেট্রিক। রমজানকে কেন্দ্র করেই খেজুরের বাড়তি আমদানি হয়েছে। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ৮০ হাজার মেট্রিক টন। কনজ্যুমারস অ্যসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নেতারা বলেছেন, অজুহাত দাঁড় করিয়ে দাম বেশি নিচ্ছে খেজুরসহ অন্য আমদানি ফলের; উদ্দেশ্য ক্রেতাদের ঠকিয়ে বাড়তি মুনাফা আদায় করা। অথচ খেজুরসহ সব ধরনের ফল আমদানি স্বাভাবিক আছে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, গত বছরের ডিসেম্বরে ২৪ হাজার ৬০ টন তাজা ফল আমদানি হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। তাজা ফলের মধ্যে রয়েছে আপেল, মাল্টা, আনার, নাশপাতি, আঙ্গুর ও কমলা। গেল জানুয়ারি মাসে এসব ফল আমদানি হয়েছে ২৬ হাজার ১২১ টন। আর গেল ফেব্রুয়ারি মাসে তাজা ফল আমদানি হয়েছে ২৩ হাজার ৩০৩ মেট্রিক টন। অন্যদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেকর্ড খেজুর আমদানি হয়েছে। এর মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আমদানি ৬৯৯ টন, অক্টোবরে ২ হাজার ৩৪১ টন, নভেম্বরে ২ হাজার ১১০ টন, ডিসেম্বরে ৬ হাজার ১০০ টন, জানুয়ারিতে ৬ হাজার ৬০০ টন। সব চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে গেল ফেব্রুয়ারিতে। এই এক মাসেই ২৭ হাজার টন খেজুর আমদানি হয়েছে।

চট্টগ্রাম কাস্টম সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর খেজুরের চাহিদা প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে রমজান মাসে চাহিদা থাকে তুলনামুলকভাবে বেশি। গত বছরের তুলনায় এবার আমদানি বেশি। ব্যবসায়ীরাও দাবি করেছেন আমদানি বেশি।

নগরীর কদমতলীর বৃহত্তম ফলমন্ডির দোতলা একটি অংশজুড়ে রয়েছে খেজুরের পাইকারদের দোকান। আর এই দ্বিতল ভবনের আশপাশজুড়ে রয়েছে আপেল, কমলা, মাল্টা, আঙ্গুর, আনার ও নাশপাতির পাইকারদের দোকান। ফলমন্ডির খেজুরের দোকানগুলোর ভেতরে গিয়ে দেখা যায় কার্টন ভর্তি খেজুর সামনে ভেতরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। দুই তিন কেজির প্যাকেট পলিথিন দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় দোকানের সামনেই রাখা হয়েছে। মেসার্স মিজান অ্যান্ড ব্রাদার্সের মালিক মোহাম্মদ মারুফ বলেন, খেজুরের দাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাড়ছে। রোজাকে সামনে রেখেই মূলত দাম বাড়ছে। আমরা আমদানিকারক নই। আমদানিকারকদের কাছ থেকে কিনে পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি করি খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে। দাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, দামী খেজুরের মধ্যে ‘আজওয়া’ খেজুর বেশ পরিচিত। সৌদি আরব থেকে আমদানি করা ৫ কেজির এক কার্টন আজওয়া খেজুরের দাম এখন ৫ হাজার ১০০ টাকা। ১৫ থেকে ২০ দিন আগে একই মানের একই পরিমাণ খেজুরের কার্টনের দাম ছিল চার হাজার টাকা। কেজির প্রতি কার্টনেই দাম বেড়েছে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকার বেশি। প্রতি কেজিতে দাম পড়েছে ১ হাজার টাকা বেশি। আজওয়া খেজুরের মধ্যে মান ভেদে কিছু খেজুর প্রতি কেজিতে দাম পড়ছে ৯০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা, যা গত বছর প্রতি ৬০০ থেকে ৭০০ টাকায় পাওয়া যায়।

সাধারণ মানের খেজুর পাইকারিভাবে বিক্রি করছে ৪০০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকা কেজি। মরিয়ম খেজুর পাইকারিতে দাম পড়ছে প্রতি কেজিতে ৯০০ টাকার বেশি। খুচরায় তা ১ হাজার টাকা পর্যন্ত দাম হাঁকা হচ্ছে। সাধারণ মানের খেজুরগুলো কেজি ৩৫০ টাকা থেকে ৪৫০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে।

খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে ব্যবসায়ীরা খেজুর বিক্রি করেন পাইকারি হারে। খেজুরসহ বিভিন্ন ফলমুলের আড়তদার মো. সাহেদ আলী বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি খেজুর প্রথমে গোডাউনে পাঠানো হয়। সেখান থেকে দরদাম করে বস্তা বা কার্টন প্রতি হিসাব করে আমরা খেজুরসহ আমদানি ফল ক্রয় করি। এবার গত বছরের চেয়ে খেজুরের দাম বেশি। প্রতি কেজিতে সব ধরনের খেজুরের দাম বেড়েছে। ভালো মানের খেজুরের দাম কেজিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। সাধারণ মানের খেজুর ১০০ টাকা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত দাম বেড়েছে। আর রোজার সময় ঘনিয়ে আসায় দাম আরো বাড়ছে।

এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর আমদানি করা ফলের পাইকারদের বড় আড়ত ফলমন্ডিতে পর্যাপ্ত সরবরাহ নেই। ৩ বছর আগে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে গড়ে ১০০ কনটেইনার ফল আমদানি হতো। এখন প্রতি মাসে গড় আমদানি ২০ মেট্রিক টন করে। ফল আমদানিকারকরা বলেছেন, ডলার সংকট নানা কারণে আমদানি কমে গেছে। আমদানিকারকরা অনেকেই এখন দেওলিয়া হয়ে গেছেন। তাই ফল মন্ডিতে ফলের সরবরাহ কমে গেছে। এতে শুধু চট্টগ্রামের বাজারে নয়, সারা দেশের বাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আসন্ন রমজানে ফলের সরবরাহ পর্যাপ্ত রাখা নিয়েও ব্যবসায়ীরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

চট্টগ্রাম নগরীর ‘ফলমন্ডি’ ফলের পাইকারদের বড় আড়ত হিসাবে পরিচিত। কদমতলী এলাকায় অবস্থিত বড় অংশজড়েই ফলের বাজার। বিদেশ থেকে আমদানি করা ফলমুলের বড় আড়ত হলেও দেশীয় বিভিন্ন ফলমুলও পাওয়া যায়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত-মিয়ানমারের পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকিা, আফগানিস্তান, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয় নানা প্রজাতির ফলমুল। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের আমদানি করা খেজুর পাওয়া যায় ফলমন্ডিতে। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা অন্যফলমুলের মধ্যে আছে আছে মাল্টা, আপেল, ডালিম, কমলা, আনার, আঙ্গুর, খেজুর, স্ট্রবেরি। ফলমন্ডিতে নতুন ও পুরোনো ৩০০ ফলের আড়ত এবং দোকানে চলে বিকিকিনি। স্বাভাবিক সময়ে দিনে বিকিকিনি হয় অন্তত ৫০ কোটি টাকার ফলমূল। সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতিবার এবং রোববার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়। সপ্তাহের এই দুই দিনে বেচা-বিক্রি হয় অন্তত ১৫০ কোটি টাকা থেকে ২০০ কোটি টাকার ফলমূল। ভারত-চীন থেকে মাল্টা, মিশর থেকে আসে কালো আঙ্গুর ও আনার। অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসে আপেল। গড়ে প্রতিদিন এই মার্কেটে দেশীয় ফলও বেচাকেনা হয় প্রচুর। কাস্টমসের তথ্যে আমদানি স্বাভাবিক দেখা গেলেও চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ ঘাটতি থাকার কথা জানালেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, বিদেশ থেকে আমদানি-নির্ভর ফলমন্ডিতেও ডলার সংকটের প্রভাব পড়েছে। ব্যাংকে আমদানির জন্য এলসি খুলতে না পারার প্রভাব পড়েছে বৃহত্তম ফলের এই বাজারে। এতে খুচরা বাজারে কমেছে সরবরাহ। দামও বাড়ছে দ্রুত গতিতে। দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালের বাইরে হওয়ায় বিক্রিও কমেছে অনেক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত