গাড়ি পাহাড়ের গাঁ বেয়ে হাজার ফুট নিচে নামছে তো নামছে, আবার খাড়া পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে। একবার দুবার নয়, অনেকবার। যেন শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়ার মতোই, যেন সাক্ষাৎ যমদূত আশপাশে রয়েছে। আছে উঁচু নিচু পাহাড়, সবুজ অরন্য, ভূমিধসের ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা। আছে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাওয়া ব্যাপক স্বপ্নবাজ মানুষের পাহাড়ের গা বেয়ে কিংবা উঁচু পাহাড়ের বুকে রাস্তা বানানোর সত্যিকারের গল্প! তারপরও সর্পিল এই রাস্তাটি ভয়ংকর, আবার সুন্দরও। পদে পদে মৃত্যু সেখানে ওত পেতে থাকে। অথচ কোনো মতে পার হতে পারলেই আপনি পাবেন জীবনের সেরা মুহূর্তের স্বাদ। যেদিকে তাকাবেন চোখ ফেরানো যাবে না। প্রকৃতির অনিন্দ্য সুন্দর মুগ্ধতার চাদরে জড়িয়ে ধরবে। সৌন্দর্যের টানে বিপদ সংকুল পথ জেনেও আপনি বারবার যেতে চাইবেন। এমন ভয়ংকর সুন্দর সীমান্ত সড়ক নির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। রাঙামাটি খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানকে যুক্ত করা এই সীমান্ত সড়ক অনেক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিচ্ছে। এই সড়কটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে নিরাপত্তাসহ পর্যটন সম্ভাবনা ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটবে। সীমান্ত এলাকায় অস্ত্র, মাদক ও মানব পাচার বন্ধ হবে। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানসহ সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হবে। পর্যটন সম্ভাবনা প্রসারিত হবে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে ব্যবসা ও বাণিজ্যেও প্রসার ঘটবে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের (ইসিবি) তথ্য মতে, সীমান্ত সড়কের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার। সীমান্ত সড়কটি রাজস্থলী সদর হতে বিলাইছড়ির ফারুয়া-জুরাছড়ি দুমদুম্যা হয়ে মিয়ানমার ও ভারত সীমান্তে পৌঁছাবে। তিনটি পর্যায়ে এটি বাস্তবায়িত হবে। একনেকে অনুমোদিত এখন প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া এই সড়ক ৩ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৩১৭ কিলোমিটারের কাজ প্রায় শেষের পথে। প্রকল্পের বাকি কাজ চলতি বছরের জুনের মধ্যে শেষ হবে। পরবর্তী দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের ৬৬৭ কিলোমিটার কাজ বাস্তবায়ন হলে সীমান্ত দেশের সাথে পাহাড়ের তিন জেলা যুক্ত হবে। এদিকে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ সড়কের উদ্বোধন করবেন বলে জানান তারা।
জানা গেছে, পাহাড়ের দীর্ঘতম এই সীমান্ত সড়কটি নির্মাণে প্রকৃতিকে অক্ষত রেখে গুণগতমান বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্সের ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগ্রেডের অধীনস্থ ১৭.২০ এবং অ্যাডহক ২৬ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নের সেনা সদস্যের হাতে ন্যস্ত করা হয়। গত শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেনাবাহিনীর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে কাজের গুণগতমান বজায়, পর্যটকবান্ধব এই সড়ক নির্মাণে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক কর্নেল ভূঁইয়া মো. গোলাম কিবরিয়া জানান, এটি এক প্রকার অসাধ্য সাধন। কঠিন চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে, চ্যালেঞ্জকে জয় করতে জানে। উঁচু পাহাড়, গভীর খাদ, ভূমিধস, প্রকৃতির বৈরি আচরণ, আঞ্চলিক সংগঠনের অপতৎপরতা, পরিবহন ও যোগাযোগ সংকটসহ নানা চ্যালেঞ্জ পেছনে রেখে সড়কটি এখন আলোর মুখ দেখেছে। প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার পথে। আশা করা হচ্ছে, জুনের আগেই প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হবে। সড়ক, পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী সরেজমিন সড়কটি পরিদর্শনে এসে সাংবাদিকদের জানান, সড়কটি দেখলাম। এমন দুর্গম অঞ্চলে এত দীর্ঘ ও কঠিন কাজ সেনাবাহিনী করে দেখিয়েছে, আমি অভিভূত। এটি সেনাবাহিনী বলেই সম্ভব হয়েছে। সড়কের বাকি দুটি পর্যায়ের কাজ দ্রুত শুরু হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, গ্রাম হবে শহর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার প্রতিফলন হচ্ছে এই সীমান্ত সড়ক। এতে করে বছরের পর বছর সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী উন্নতির মূল ধারায় প্রবেশ ও নিজেদের আত্মসামাজিক উন্নয়নে সুযোগ পাচ্ছেন।