সদ্য বিবাহিত স্ত্রীর হাতের মেহেদি মুছে যাওয়ার আগেই বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক (ওয়েলার) হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন হোসাইন মোহাম্মদ আলী (২৬)। গত মঙ্গলবার জাহাজটি সাউথ আফ্রিকা থেকে কয়লা বোঝাই করে সংযুক্ত আরব আমিরাত যাওয়া যাচ্ছিল। ওই দিনই ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুর কবলে পড়ে জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। এতে ২৩ নাবিকের সঙ্গে জিম্মি হন মাত্র দুই মাস আগে যোগ দেওয়া বরিশালের বানারীপাড়ার সন্তান আলী। বাবা ইমাম হোসেন মল্লিকের সঙ্গে আলীর সব শেষ কথা হয়েছিল গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। তারপর থেকে আর তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছে না পরিবারের সদস্যরা। তখন আলী বলেছিলেন, বেঁচে ফিরলে কথা হবে। এর পর থেকেই চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছে তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী ইয়ামিনসহ বাবা-মা পরিবার।
মোহাম্মদ আলীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারী গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী আলী বাইশারীর কুমাড়ের পাড় বিশারকান্দি সম্মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ২০১৪ সালে মাধ্যমিক পাস করে। তখন তিনি জিপিএ-৫ পেয়ে এর পরে চার বছরের কোর্সে ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জের মেরিন অ্যাকাডেমিতে। সেখানে চার বছর পড়ালেখা শেষ করে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ২০২০ সালে চাকরিতে যোগ দেন। গত দুই মাস আগে কেএসআর এম শিপিং লি. এর নিজস্ব খরচে সাউথ কোরিয়াতে গিয়ে এমভি আবদুল্লাহ নামের ওই জাহাজে নাবিক হিসেবে কাজ শুরু করেন আলী। মাত্র ৮-৯ মাস আগে আলীর সঙ্গে বিয়ে হয় ইয়ামনির। ইয়ামনির বাড়ি পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলায়।
জলদস্যুদের হাতে আলী অপহৃত হওয়ার পর মোহাম্মদ আলীর পরিবারের সবাই ভিষণ উদ্বিগ্ন। তার বাবা ইমাম হোসেন মল্লিক জানান, ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। এর আগে বিকাল ৩টার দিকে ফোন দিয়ে সে জানায়, তাদের জাহাজ জলদসস্যুদের কবলে পড়ার ঘটনা। সর্বশেষ সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে জানায় তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সোমালিয়ার দিকে। আরও জানায়, এখন থেকে মোবাইলসহ জাহাজ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে জলদস্যুরা। ফলে বেঁচে না ফেরা পর্যন্ত আর কথা হবে না পরিবারের কারও সঙ্গে। তাই সরকারের কাছে আলীর বাবার দাবি, যে কোনো উপায় তার সন্তানসহ অপহৃত হওয়া জাহাজের ২৩ নাবিককে উদ্ধারের।
যে জাহাজটি ছিনতাই হয়েছে ওই কোম্পানিতেই ছিলো আলীর প্রথম চাকরি। এর আগেও দুবার জাহাজে চেপে বিদেশে গিয়েছিল সে। এটা ছিলো তার তৃতীয়বারের সমুদ্রযাত্রা। দুই ভাইয়ের মধ্যে পরিবারের ছোট ছেলে আলী হোসেনের আরেক ভাই জুলফিকার চাকরি করে পল্লী বিদ্যুতে। দুই ভাই বাবা, মা, ভাবি আর স্ত্রীকে নিয়েই আলীর সংসার। আলীর বাবা জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় শেষ বারের মতো কথা হওয়ার বহুবার চেষ্টা করেও আলীর মোবাইলে আর কল প্রবেশ করেনি। ফলে ছেলের সঙ্গে কথাও বলতে পারেননি তিনি।
আলী হোসেন যে জাহাজে চাকরি করে সেই কোম্পানির পক্ষ থেকে ফোন দিয়ে সান্ত¡না দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বানারীপাড়া থানা পুলিশের পক্ষ থেকেও তার বাড়িতে কর্মকর্তারা যাওয়ার পাশাপাশি মোহাম্মদ আলীর মুক্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছে।
আলী হোসেনের স্ত্রী মোসাম্মত ইয়ামনি জানান, আগামী কোরবানির ঈদে বাড়িতে ফেরার কথা ছিল আলীর। পরিকল্পনা ছিল দুজন মিলে ঈদের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাবেন। এমন ঘটনার কথা কখনো ভাবেননি। স্বামীকে ফেরত পাওয়া ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই তার।
আলীর মা নামিমা পারভিন জানান, কোরবানির ঈদে বড় ভাইয়ের সঙ্গে বাড়িতে এসে একসঙ্গে কোরবানি দেওয়ার কথা ছিলো আলীর। এমন অঘটনে সেই স্বপ্ন পূরণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
বিশারকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম শান্ত জানান, এ পরিবারের মেধাবী ছেলে আলীর পরিবারের পাশে থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হচ্ছে। তার উদ্ধারে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।