কৃষিনির্ভর এলাকা হওয়ায় রবিশস্য মৌসুমে শরীয়তপুরে অধিক পরিমাণে মধু উৎপাদন হয়। শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকায় বেকার যুবকরা মধু উৎপাদন করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও রাখছেন ভূমিকা। বর্তমানে তারা বাণিজ্যিকভাবে কালোজিরা ফুলের মধু সংগ্রহ করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। বছরজুড়ে মৌমাছি লালন-পালনসহ অন্যান্য খরচ মিটিয়ে লাভের মুখ দেখবেন মৌ চাষিরা, এমনটাই প্রত্যাশা কৃষি বিভাগের। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে, এ বছর শরীয়তপুর জেলায় কালোজিরা ৩৫২০ হেক্টর, ধনিয়া ৬০৫৬ হেক্টর এবং সরিষা ১৪৫০ হেক্টর মিলে মোট ২৪০২৬ হেক্টর জমি আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১০৪০ হেক্টর জমি মৌ চাষের আওতায় রয়েছে। এতে মৌবাক্স স্থাপন করা হয়েছে ৯৫৮০টি। আর এ মৌসুমে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত মধু সংগ্রহ হয়েছে ২০১২০ কেজি। এর মধ্যে কালোজিরার মধু ৩৪৮০ কেজি, ধনিয়ার মধু ৯৪৫০ কেজি এবং সরিষা ফুলের মধু ৭১৯০ কেজি। তবে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবার মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ৩০৬০০ কেজি। সাধারণত অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে বেশি পরিমাণে মধু সংগ্রহ হয়। মৌ বাক্সের মাধ্যমে মধু সংগ্রহে মৌচাষি ও শস্যচাষি উভয়ই লাভবান হয়ে থাকেন। মধু চাষের মাধ্যমে মৌচাষিরা যেমন বাড়তি আয় করেন, তেমন মৌমাছির পরাগায়ণের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। মৌচাষি শাহীদুল ইসলাম জাজিরা উপজেলার বিলাসপুরের কাইজ্জার চর ও নড়িয়া উপজেলার ঈশ্বরকাঠি গ্রামে কালোজিরার মৌ খাবার গড়ে তুলেছেন। এসব মধু তিনি পাইকারি ও খুচরা বিক্রি করেন। প্রথমে পাঁচটি বাক্স দিয়ে শুরু করলেও এ বছর তার খামারে ২০০ মৌ বাক্স রয়েছে। শাহীদুল বলেন, সারা বছর মৌমাছিদের লালন-পালন, কর্মচারীদের বেতনসহ আমার খরচ হয় ৬ লাখ টাকা। এ বছর আমার টার্গেট ১২ লাখ টাকা মূল্যের মধু উৎপাদন করা। টার্গেটের বড় একটা অংশ আমি কালোজিরা ফুলের মধু থেকে উত্তোলন করতে পারব বলে আশাবাদী। তিনি আরও বলেন, এক সময় বেকার ছিলাম। এখন আমার খামারে ৫ জন কর্মচারী কাজ করে। গত বছর ৪ টন মধু বিক্রি করেছি। এ বছর ৫ থেকে ৬ টন মধু উৎপাদন করে বিক্রি করতে পারব বলে আশা করছি। মৌ খামারের কর্মচারী ছানোয়ার হোসেন বলেন, মৌমাছির সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে আমার। মৌ খামার থেকে যে বেতন পাই, তা দিয়ে আমার সংসার চলে যায়। মধু বেশি উৎপাদন করতে পারলে মালিক সম্মানি দেন বেশি। এ বছর মধু উৎপাদন ভালোই হবে বলে মনে হচ্ছে। মৌ খামার দেখতে আসা সাগর মিয়া বলেন, পড়াশোনা প্রায় শেষ করেছি। দেশে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। বাবা কৃষক হওয়ায় কৃষি কাজ করতে ভালোই লাগে। আমার ইচ্ছে আছে মৌ চাষ শিখে মৌ চাষ করব। আরেক মৌ খামারি ওয়াহিদুর রহমান বলেন, আমি নড়িয়া এবং জাজিরা উপজেলার বিলাসপুর ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ কালোজিরা ক্ষেতে ১৬৫টি মৌ বাক্স বসিয়েছি। এসব বাক্স থেকে প্রতি বছরে গড়ে প্রায় সাড়ে ৪-৫ টনের মতো মধু পাওয়া যায়। কালোজিরার মধু ১৫০০-১৮০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। জাজিরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সহকারী অধ্যাপক (কৃষি) দিপক প্রকাশ বসু বলেন, জাজিরার কালোজিরার মধু জেলার ব্রান্ডিং পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এটা গর্বের বিষয়। কালোজিরার মধু মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। আশাকরি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর উৎপাদন আরো বেশি বৃদ্ধিতে কাজ করবেন। জাজিরা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বিথী রানী বিশ্বাস বলেন, এ বছর জাজিরাসহ অন্যান্য উপজেলায় প্রচুর পরিমাণে রবিশস্য উৎপাদন হয়েছে। এ মৌসুমে জেলার মৌ চাষিরা বিভিন্ন স্থানে উৎসাহ নিয়ে মধু উৎপাদন করছে। নিজেদের ভাগ্য বদলের পাশাপাশি মানবদেহের জন্য উপকারী মধু উৎপাদন করে তারা দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখতে ভূমিকা রাখেন। গত বছরের তুলনায় এ বছর আমাদের মধু উৎপাদন বেশি হবে বলে আশা করছি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসের উপ-পরিচালক ড. রবীআহ নূর আহমেদ বলেন, আমরা আমাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা করছি বর্তমানে শরীয়তপুরে যে পরিমাণ মৌচাষ করা হচ্ছে তা আরো বৃদ্ধি পাক। শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দীন আহাম্মেদ বলেন, এ বছর জাজিরায় কালোজিরার মধু অধিক উৎপাদন হওয়ায় জেলা ব্রান্ডিং পণ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বর্তমানে এর চাহিদাও বাড়ছে। আরো বেশি উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে জেলা প্রশাসন।