গত বুধবার দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে বঙ্গবন্ধু টাওয়ার মসজিদে রোজা নিয়ে আলোচনার জেরে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে ঢাবি ছাত্রদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী। এতে আইন বিভাগের পাঁচ ছাত্র গুরুতর আহত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের বাসভবন বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের গেটের সামনে শিক্ষার্থীদের ওপর এই হামলা করা হয়।
ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তাওহীদুল ইসলাম সুজন এসে তাদের হুমকি-ধমকি দেন এবং সুজনের নেতৃত্বেই বের হয়ে যাওয়ার সময় ভবনের মূল ফটকের সামনে থেকে প্রায় ৪৫-৫০ জন তাদের ওপর হামলা করে এবং পরে বাইক নিয়ে চলে যায়। ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, ছাত্রলীগ নেতা সুজনকে ডেকে নেন টাওয়ার কল্যাণ সমিতির সভাপতি সিরাজুল ইসলাম। যদিও সিরাজুল এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা মিথ্যা কথা। আমি সে সময় নামাজে ছিলাম।’
এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীরা হলেন সাকিব আজাদ তুর্য, শাহিনুর আলম রাসেল, রাফিদ হাসান সাফওয়ান, ফাহিম দস্তগীর, রেজোয়ান আহমেদ রিফাত। তারা প্রত্যেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। এদিকে এ ঘটনার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন আইন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের সামনে আবারও মানববন্ধন করেন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে শিক্ষার্থীরা অতিদ্রুত এ ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। মানববন্ধন শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ কামাল ও প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমানের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, শিবির ট্যাগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের নির্যাতন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে এই রাজনীতি নতুন না। যাকে মারবে সে শিবির, যে কোনো অন্যায় করবে, যে কোনো অপরাধ করবে সবকিছু ঢাকা হয় শিবির ট্যাগ দিয়ে। আমরা ছাত্রলীগ কিংবা সরকারকে স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আপনাদের যদি এতই শিবিরভীতি থাকে তাহলে আইন করে শিবিরকে নিষিদ্ধ করেন না কেন?
আসিফ নজরুল বলেন, ধারণা করে, মিথ্যা অভিযোগ করে কাউকে মারতে পারেন না আপনারা। এটা গুরুতর অপরাধ, ফৌজদারি অপরাধ। আমি অনেক খোঁজ নিয়ে দেখেছি আমাদের যেসব শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করা হয়েছে তারা শিবির কেন, কোনো সংগঠনের সঙ্গেই জড়িত নয়। আমি মনে করি তাদের শিবির করার জন্য মারা হয়নি, তাদের মারা হয়েছে ইসলামী মাহফিল করার জন্য। বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মীয় সমাবেশ করবে, সেটার জন্য মার খাবে সেটার জন্য আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম?
হামলার শিকার হওয়া আইন বিভাগের শিক্ষার্থী সাফওয়ান বলেন, আমাদের এই প্রোগ্রামে হামলা হবে আমরা ভাবতেও পারিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিরাপদ ক্যাম্পাস বলে আমরা যেটাকে মনে করি, সেখানে বহিরাগত ছাত্রলীগ নেতারা এসে আমিসহ আমার সহপাঠীদের ওপর হামলা করে রক্তাক্ত করে। আমরা জানি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যারা আছেন তারা আমাদের বিভাগের। তাদের বিভাগের শিক্ষার্থী হয়েও যদি আমাদের এভাবে ন্যাক্করজনক হামলার শিকার হতে হয় আর তারা তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে আমরা কীভাবে তাদের সিনিয়র ভাই মনে করব। আমরা এ হামলার কঠিন বিচার চাই।
আইন বিভাগের ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও গণতান্ত্রিক ছাত্র শক্তির কেন্দ্রীয় সভাপতি আখতার হোসেন বলেন, গত বুধবার বিভাগের অনুজদের ওপর বর্বরোচিত হামলা করা হয়েছে। ঘটনা শোনার সাথে সাথেই আমি সেখানে উপস্থিত হই। আমি এসে দেখি আমার অনেক অনুজ সেখানে বন্দি রয়েছে, তারা সেখান থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছিল। আমি প্রক্টর স্যারকে কল দিয়েছিলাম; কিন্তু তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান। এ সময় তিনি প্রক্টরিয়াল টিম পাঠাননি এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারা কথাও বলেননি।
বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নিন্দা
শুধু আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরাই নন, এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবির। গত বুধবার পৃথক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনগুলো থেকে প্রতিবাদ জানানো হয়। প্রতিবাদে সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা এই হামলার নিন্দা জানিয়ে অভিযুক্তদের শনাক্ত করে দ্রুত বিচারের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানায়।
থানায় অভিযোগ
এদিকে এ ঘটনার পর গতকাল রাজধানীর শাহবাগ থানায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের পক্ষে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন হামলার শিকার বিভাগের শিক্ষার্থী সাফওয়ান। অভিযোগে তিনি ছাত্রলীগ নেতা সুজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০-৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণের আবেদন করেছেন। এ বিষয়ে সাফওয়ানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে আইন বিভাগের ৪৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী আখতার আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, আমরা থানায় সুজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ২০-৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছি। পুলিশ আমাদের আবেদনটি রিসিভ করেছে। তারা (পুলিশ) জানিয়েছে, এ বিষয়ে তদন্ত করে পরবর্তীতে আপডেট জানানো হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাজিরুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘তারা একটি অভিযোগ দিয়েছে। তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
যা বলছে ঢাবি প্রশাসন
এদিকে এ ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাকসুদুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, শিক্ষার্থীরা ভিসি ও আমাকে স্মারকলিপি দিয়েছে। আমরা তাদের সকল ধরনের সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছি। যে ধরনের সহযোগিতা লাগে দিব। পাশাপাশি এই ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা অতি দ্রুত কাজ শুরু করবে।