প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে ঘেরা একটি জমি। চারদিকে নেটের ছাউনি, উপরেও নেটের ছাউনি দিয়ে ঘেরা। জমির পরিমাণ মাত্র ৬০ শতক। চাষ করা হচ্ছে পুষ্টিসমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় ক্যাপসিকাম। তবে গ্রামের মানুষ এখনো এর নামটাও ঠিকমতো জানে না। কীভাবে খেতে হয়, কোথায় কীভাবে বিক্রি হয়, তাও না জানলেও প্রথমবার ক্যাপসিকাম চাষ করেই বাজিমাত করেছেন কৃষক সবুজ আলী। খাবারে বাড়তি স্বাদ যোগ করতে ক্যাপসিকাম ব্যবহার করা হয়। বাজারে সবুজ, লাল, হলুদ এই তিন রঙের ক্যাপসিকাম পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ক্যাপসিকামে ৮৬০ মিলিগ্রাম প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ভিটামিন সি থাকে। এছাড়া এতে ভিটামিন বি, ই, কে, থিয়ামিন, ফলিক অ্যাসিড, রাইবোফ্ল্যাভিন ইত্যাদি পাওয়া যায়। সবুজ ক্যাপসিকাম একটু অল্প বয়সিদের জন্য উপকারী। এতে ক্যাপসাইসিনস নামক এক ধরনের উপাদান থাকে, যা ডিএনএ’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদানের সংযুক্ত হওয়াতে বাধা দেয়। এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে। এছাড়া ক্যাপসিকাম মাইগ্রেন, সাইনাস, সংক্রমণ, দাঁতে ব্যথা ইত্যাদি ব্যথা দূর করে। নিজ নামের সঙ্গেই মিল করেই কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের জঙ্গলী কৃষি ব্লকের কাঞ্চনপুর এলাকার কৃষক সবুজ আলী চাষ করেছেন সবুজ রঙের ক্যাপসিকাম জাত অরবিট। মাত্র দুই মাসেই বিক্রি করেছেন লাখ টাকা। আশা করছেন তিন মাসেই ৭ লাখ টাকার ক্যাপসিকাম বিক্রি করবেন এ কৃষক। উদ্ভ্ট, পাগলামি, জমি নষ্ট, ফালতু জিনিষ চাষ, ফল হবে, খরচ উঠবে না- এমন নানান কথা গ্রামের অন্য চাষিদের কাছ থেকে শুনতে হয়েছে সবুজকে। এখন তার সাফল্যে অন্য চাষিদের কাছে রোল মডেল সবুজ। ইতোপূর্বে ওই এলাকার মানুষ ক্যাপসিকাম চাষ সর্ম্পকে জানত না। এখন তার জমিতে ক্যাপসিকাম দেখতে ও চাষ শিখতে প্রতিদিনই ভিড় করেন অনেকেই। ইন্টারনেটের মাধ্যমে শুরুতে ক্যাপসিকাম চাষের ভিডিও দেখেন কৃষক সবুজ। পরে তিনি যোগাযোগ করেন কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসে। সেখান থেকে তিনি ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন। পরে কৃষি অফিসের সহযোগিতায় প্রথমবার চাষ শুরু করেন তিনি। কৃষক সবুজ জানান, মোবাইলে কৃষি বিষয়ে ভিডিও দেখতে দেখতে ক্যাপসিকাম এর ভিডিও আসে। সেটা দেখি এবং চাষ করার চিন্তা করি। কিন্তু এটা কীভাবে চাষ করে, সেটা জানতাম না। তাই উপজেলা কৃষি অফিসে যায়। সেখানে তারা আমাকে ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেয়। কিছুদিন পরে আমি যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে কুমারখালী উপজেলা কৃষি অফিসে তিন দিনের নিরাপদ উপায়ে সবজি চাষের প্রশিক্ষণ নেয়। সেখানে কিটনাশক ছাড়া ও পানি কম লাগবে কীভাবে সে সম্পর্কে জানতে পারি এবং ক্যাপসিকাম চাষ সম্পর্কে জানতে পারি। এর কিছুদিন পর আমাকে ২০ শতাংশ জমিতে ক্যাপসিকাম করার জন্য প্রদর্শনী দেন তারা। কিন্তু আমি তার সঙ্গে আরো ৪০ শতাংশ যোগ করে প্রথমবার ৬০ শতাংশ জমিতে এ ক্যাপসিকামের চাষ শুরু করি। ভালোভাবে জমি চাষ করে আমি অক্টোবর মাসের দিকে ক্যাপসিকামের চারা লাগাই। ৬০ শতাংশ জমিতে আমি ৬ হাজার ৫০০ মতো চারা লাগিয়েছি। লাইন করে ফাঁকা করে আমি এ চারা লাগাই। জমিতের যাতে পোকামাকড় এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে তাই নেট ব্যবহার করেছি। এতে পাখিরও কোনো উপদ্রব নেই। সেই সঙ্গে পানি সেচের অপচয় কমাতে আমি মালচিং ব্যবহার করেছি। এ কারণে আমার জমিতে আগাছা হয়নি এবং সার ও পানি সেচ কম লাগছে। চাষের খরচও অনেক কমে গেছে। তিনি বলেন, প্রায় ২ বিঘা জমিতে আমি কোনো প্রকার কীটনাশক দিইনি। পোকা দমনের জন্য কৃষি অফিসের দেওয়া আমি হলুদ ও সাদা আঠাযুক্ত ফাঁদ ব্যবহার করেছি। চাষ সম্পর্কে তিনি বলেন, ক্যাপসিকাম চাষ খুবই সহজ। আমরা যেমন মরিচ চাষ করি ঠিক তেমনি। তবে একটু খেয়াল রাখতে হবে যাতে রোগবালাই না লাগে। আর যেহেতু এটা সালাদ বা কাঁচা খাওয়া যায় এজন্য কীটনাশক মুক্ত চাষ করা।
সবুজ আরো জানান, কৃষি অফিস থেকে আমাকে ২০ শতক জমির জন্য ক্যাপসিকামের চারা, মালচিং পেপার, বাঁশ-খুঁটি, নেট ও সার দিয়েছিল। এছাড়া সব মিলিয়ে আমার মোট ২ লাখ ৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়েছে। এরই মধ্যে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকে ক্যাপসিকাম তোলা শুরু করেছি। বেশ ভালো হয়েছে এবং ফলগুলোও বেশ বড় বড় হয়েছে। এর মধ্যে আমি এই জমি থেকে ১ হাজার কেজি ক্যাপসিকাম তুলেছি, যা কুষ্টিয়া শহরে ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি। গড়ে ২০০ টাকা ধরে হলেও ২ লাখ টাকার মতো বিক্রি করেছি। এখনো যে পরিমাণ ফল আছে, তাতে আরো ২ হাজার কেজি মতো তোলা যাবে। এছাড়া আরো ধরছে। আশা করছি ৫ থেকে ৭ লাখ টাকার মতো বিক্রি করতে পারব।
তিনি জানান, গ্রামের মানুষ তো এটা চেনে না। আমি স্থানীয় বাজারে বিক্রির জন্য ৪ কেজি দিয়েছি এক দোকানে। এটা কীভাবে খেতে হয়, সেটা বলতে বলতে ওই দোকানি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। শহরে ছাড়া বিক্রি প্রায় অসম্ভব এখন। আর বাজারে বরিশাল এলাকার ক্যাপসিকাম আসায় দাম একটু কমে যাচ্ছে। ওই এলাকার কৃষক হাফিজুর রহমান জানান, যখন সবুজ বলল যে এখানে ক্যাপসিকাম লাগাব তো এর নামই মনে থাকত না। যে এটা আবার কি জিনিষ। এর আগে কোনোদিন দেখা তো দূরের কথা নামই শুনিনি। তবে যখন হলো তখন সবাই দেখতে আসা শুরু করল। এখন এখছি এটা লাভজনক। আগামীতে এলাকায় ব্যাপকভাবে চাষাবাদ হবে। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, আমরা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে কৃষকদের আধুনিক চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করণে এখানে জৈব উপায়ে চাষাবাদ করানোর চেষ্টা করছি। সবুজ নামের এই কৃষক নিরাপদ উপায়ে ক্যাপসিকাম চাষ করছেন। বর্তমানে তার খেতের অবস্থা খুবই ভালো এবং তিনি বেশ লাভবান হবেন। কুমারখালী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দেবাশীষ কুমার দাস জানান, কৃষি পরামর্শের পাশাপাশি নিরাপদ উপায়ে উচ্চমূল্যের সবজি চাষে আমরা কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনী দিয়ে আসছি। যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্প এর আওতায় নিরাপদ সবজি চাষে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাঞ্চনপুর এলাকার কৃষক সবুজ ক্যাপসিকাম চাষ করে বেশ সাফল্য পেয়েছেন। তিনি পানি সাশ্রয়ী ও নিরাপদ উপায়ে এ ক্যাপসিকামের চাষ করছেন। বাজারে ভালো দামও পাচ্ছেন। তার দেখাদেখি এলাকার অনেক কৃষক এখন ক্যাপসিকাম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কৃষি প্রকৌশলী ও যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের জুনিয়র পরামর্শক (ফার্ম ম্যানেজমেন্ট ও পানি ব্যবস্থাপনা) উম্মে উমারা জানান, ‘মাটি থেকে পানি বাষ্পয়িতভাবে বাতাশে উড়ে যায়। মালচিং পেপার ব্যবহারের মাধ্যমে সবজি ফসলে পানির অপচয় রোধ করা সম্ভব। যার কারণে সেচ খরচ অনেকটা কমে যায়। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ করলে কৃষকরা অনেক বেশি উপকৃত হবে।’
যশোর অঞ্চলে টেকসই কৃষি সম্প্রসারণ প্রকল্পের মনিটরিং ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা মাসুম আব্দুল্লাহ জানান, আমরা আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের সাশ্রয়ী পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব চাষাবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। সেই সঙ্গে উচ্চমূল্যের সবজি চাষে কৃষকদের বীজ-সার থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় উপকরণ সহায়তা দিচ্ছি। যার ফলে এই অঞ্চলের কৃষকরা আরো উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. হায়াত মাহমুদ জানান, ক্যাপসিকাম উচ্চমূল্যের একটি সবজি। কৃষকরা এটি চাষ করে বেশ ভালো লাভবান হচ্ছেন। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় অনেক বেকার যুবকরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে মাধ্যমে এই ক্যাপসিকাম চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। আগামীতে এ ক্যাপসিকামের আবাদ বাড়বে বলে আশা করেন তিনি। এদিকে নেটে ঘেরা ফসলের ক্ষেত, ক্ষেতের মাঝে হলুদণ্ডসাদা পোঁকা মারার ফাঁদ, মাটিতে পলিথিন বেছানো, সবুজ গাছে থোকায় থোকায় ঝুঁলে আছে কৃষক সবুজের ক্যাপসিকাম। এটি দেখতে স্থানীয় কৃষকদের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষরাও ভিড় করছেন প্রতিনিয়ত তার জমিতে। উচ্চমূল্যের এ ক্যাপসিকাম যেহেতু গ্রামীণ পর্যায়ে উৎপাদন হচ্ছে, ঢাকাসহ বাইরের ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করার ব্যবস্থা হলে আগামীতে এ ক্যাপসিকামের চাষ আরো দ্রুত বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করেন কৃষিসংশ্লিষ্টরা।