সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের পাঁচ শিক্ষার্থীর ওপর রমজানের তাৎপর্য নিয়ে ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় ছাত্রলীগের হামলার ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। কিন্তু পরবর্তীতে হামলার ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় ভিন্ন তথ্য। ঘটনায় অভিযুক্ত বেশিরভাগই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতের ‘ছোট ভাই’ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ও ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্যানুযায়ী হামলায় জড়িতরা হলেন- ঢাবির শহীদুল্লাহ হল শাখা ছাত্রলীগের পাঠাগার উপ-সম্পাদক খালিদ হাসান নিলয়, একই হল শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আরাফাত ইসলাম প্লাবন, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আক্তারুল করিম রুবেল, বিজয় একাত্তর হল শাখা ছাত্রলীগের গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন উপ-সম্পাদক শাকিবুল ইসলাম সুজন, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের উপ-মানবসম্পদ উন্নয়ন সম্পাদক মুশফিকুর রহমান, কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম খান ও একই হলের আরেক সহ-সভাপতি রাশেদুজ্জামান রনি, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম একই হলের শিক্ষা ও পাঠচক্র সম্পাদক রাকিবুল হাসান রাহি, কবি জসীমউদ্দীন হল শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহ সুলতান অপু, ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি তাওহিদুল ইসলাম রিসাল, একই শাখার উপ-দপ্তর সম্পাদক নাঈমুর রহমান ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নাহিদ ভূঁইয়া। জানা যায়, নিজেকে আড়াল করার অপচেষ্টা থেকে ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত শাহবাগ থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তাওহীদুল ইসলাম ওরফে সুজনকে ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই এ হামলার অগ্রভাগে সুজনসহ তার কিছু বহিরাগত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর নাম এসেছে। তবে বেশিরভাগ হামলাকারীই ছিল সৈকতের অনুসারী শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী। যদিও কেউ এই হামলার কথা স্বীকার করেননি।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, প্রথমে সুজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আবাসিক ভবন ‘বঙ্গবন্ধু টাওয়ার’ এর নিচ তলায় থাকা মসজিদে গিয়ে ওই সেমিনারে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের বাইরে ডেকে আনেন। পরবর্তীতে ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরার আওতার বাইরে আনলে ভবনের মূল ফটকে এনে শিক্ষার্থীদের এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করেন ঢাবি ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
যদিও হামলা পরবর্তী সময়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত গণমাধ্যমে বলেন, ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ শীর্ষক আলোচনা সভায় যারা ছিলেন, তারা ইসলামি ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত এবং তারা সেখানে রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতা চালানোর উদ্দেশ্যে জড়ো হয়েছেন। ফলে ধর্মপ্রাণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের এ অপতৎপরতা রুখে দেয়। কিন্তু কাকতালীয়ভাবে তানভীর হাসান সৈকতের বলা ‘ধর্মপ্রাণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা’ সবাই শাখা ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সবাই রাজনীতিতে তার অনুসারী বলে জানা গেছে। ফলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ধারণা করছেন সৈকতের নির্দেশেই এ হামলার ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
এদিকে হামলায় জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন অভিযুক্তরা। অভিযুক্ত জসীম উদ্দিন হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রাশেদুজ্জামান রনি আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘হামলায় আমার কোনো ভিডিও ফুটেজ নাই। আমি ওখানে (হামলায়) ছিলাম না। কেউ যদি আমার নাম দিয়ে দেয়, তাহলে আমার কি করার আছে।’ অভিযুক্ত শাকিবুল ইসলাম সুজনকে সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা গেলেও তিনি বলেন, তখন আমি আমার হলেই ছিলাম। এ হামলার সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আরেক অভিযুক্ত জহুরুল হক হল ছাত্রলীগ নেতা রাকিবুল হাসান রাহি বলেন, আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারি, তখন আমি সেখানে ছিলাম না। রোজা রেখে দুপুরের পর আমি আমার নিজ হলে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। আরেক অভিযুক্ত নাঈমুর রহমান বলেন, শুধু ওই ঘটনা কেন, ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের ঘটনায় আপনি আমার সম্পৃক্ততা পাবেন না। শুধু ছাত্রলীগ করি বলে তারা আমার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ তুলছেন।
জসীম উদ্দিন হলের সহ-সভাপতি শাহ সুলতান অপু বলেন, আমার অসুস্থতার জন্য ঢাবি মেডিক্যালে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে সেখান থেকে আসার পথে হট্টগোল দেখে আমি বাইক দাঁড় করিয়ে ঘটনাস্থলে দাঁড়াই। এছাড়া আমি কিছুই করিনি। চিকিৎসা নেওয়ার কোনো প্রমাণ আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমি শুধু নাম এন্ট্রি করে চলে আসছি। ডাক্তার মৌখিকভাবে কিছু ওষুধ খেতে বলে দিয়েছে। তবে জানা যায়, ঢাবি মেডিক্যালে মৌখিকভাবে প্রেসক্রিপশন দেওয়ার কোনো নজির নেই।
একই হলের সহ-সভাপতি ইব্রাহিম খান বলেন, ‘আমি সেদিন অসুস্থ ছিলাম। ঘটনায় ছিলাম না, হলে ছিলাম। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমার নাম দেয়া হয়েছে। এটা প্রমাণ করতে না পারলে আমি মানহানির মামলা করব।’
ঢাবি ছাত্রলীগের উপ-মানব সম্পাদক মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘আমি কয়েকদিন ধরে জ্বরে আক্রান্ত। কেউ এসে বলে গেল আমি ছিলাম (ঘটনাস্থলে) এভাবে হয় না ভাই।’ এ বিষয়ে জানতে শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে গতকাল বিকালে ও সন্ধ্যায় একাধিকবার মুঠোফোনে কল করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এর আগে গত বুধবার দুপুরে শিক্ষার্থীদের উপর করা এ হামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৫ শিক্ষার্থী আহত হন। এ নিয়ে দফায় দফায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে আইন বিভাগের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে ডজনখানেক ছাত্র সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রক্টর ও শাহবাগ থানায় লিখিত অভিযোগও দেয় শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও এখন পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।