ঢাকা ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

টেকনাফে পাহাড় ঘিরে অপহরণ বাণিজ্য, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

* মুক্তিপণে ফিরেছে চার কৃষক, এখনো জিম্মি একজন
টেকনাফে পাহাড় ঘিরে অপহরণ বাণিজ্য, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

কক্সবাজারের টেকনাফে থামছে না অপহরণ বাণিজ্য। গত বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) ভোরে উপজেলার হ্নীলা পশ্চিম পানখালি পাহাড়ের পাশের সবজি খেত থেকে অপহৃত ৫ জনের মধ্যে চার কৃষক গত শনিবার মধ্যরাতে মুক্তিপণে ফিরে আসলেও পুলিশ দাবি করছে, তাদের তৎপরতায় অপহরণকারী চক্র ছেড়ে দিয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত অপহরণকারী চক্রের কবলে রয়েছে আরো একজন। গতকাল সকাল থেকে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। টেকনাফ পাহাড়জুড়ে পুলিশের চিরুনি অভিযান চলছে বলে দাবি করেছেন টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনি।

বিভিন্ন মহল থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, চলতি মাসের প্রথম থেকে গত শুক্রবার (২২ মার্চ) পর্যন্ত শিশুসহ ২০ জন অপরণের শিকার হয়েছে। যাদের সিংহভাগই মুক্তিপণে বাড়ি ফিরেছে বলে জানা গেছে। ভুক্তভোগীদের মতে, গত তিন বছরে দেড় শতাধিক মানুষ অপহরণকারিদের কবলে পড়েছে। তাদের মাঝে ছিল স্কুল, কলেজ-মাদ্রাস পড়ুয়া, কাঠুরিয়া, জেলে, কৃষক ও প্রবাসী। অপহরণের পর দাবিকৃত মুক্তিপণ দিতে না পেরে খুনের শিকার হয়েছেন ৫ জন। দিনের পর দিন অপহরণ বাণিজ্য বেড়ে চলায় এতদাঞ্চলের মানুষ অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

আগে অপহৃত হয়ে মুক্তিপণে ফেরত আসা টেকনাফের বাহারছড়ার বাসিন্দা ছৈয়দ আলম (৪০) বলেন, গত শুক্রবার (৮ মার্চ) জাহাজপুরার আলী আহমদসহ আমরা দুজন পানের বরজে কাজ করছিলাম। হঠাৎ ৮-১০ জনের অস্ত্রধারী দল আমাদের জিম্মি করে পাহাড়ের ভেতরে নিয়ে বেঁধে রাখে। পরে তাদের নির্যাতনে নিরুপায় হয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে অপহরণকারীদের কবল থেকে একদিন পর বাড়িতে ফেরত আসি।

হ্নীলার বাসিন্দা নুর জাহান বলেন, আমার ছেলে সোয়াত বিন আব্দুল্লাহ (৬) শনিবার (৯ মার্চ) মাদ্রাসা থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুপুরে অপহরণকারীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়।

হোয়াইক্যংয়ের বাসিন্দা মির কাসেম বলেন, গত রোববার (১০ মার্চ) সকালে আমার দুই ছেলে নুর কবির ও জসিমসহ ৭ জন উনচিপ্রাং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পাশে পাহাড়ি আগানে কাজ করতে যায়। সেখানে আরও ৫ জন কাঠ সংগ্রহ ও গরু চড়াতে গেলে ১০-১৫ জনের সশস্ত্র দল অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের পাহাড়ে নিয়ে যায়। পরে জনপ্রতি ২ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করলে অনেক দেন-দরবারে নগদের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা পৌঁছানোর পর রাতে তাদের ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা।

বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফরিদ আলম বলেন, গত সোমবার (১২ ফেব্রুয়ারি) সকালে মারিশবনিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৭ম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল আলিম মায়ের সঙ্গে পানের বরজে কাজ করতে গেলে সন্ত্রাসীরা ৪-৫ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে তাকে অপহরণ করে। এ ঘটনার ৫ দিন পরে ৬০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে তাকে ফেরত এনেছিল তার পরিবার।

তিনি বলেন, এর আগেও বাহারছড়ার সিএনজির ড্রাইভার মাহমুদুল করিম ও হ্নীলার ইজিবাইক চালক মুহাম্মদ হোসেন মুক্তিপণের টাকা দিতে না পেরে খুন হয়েছিলেন। পরে শামলাপুর ঢালা থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এ ঘটনার পর কক্সবাজারের ইউসুফ, জমির হোসেন ও ইমরান নামে তিন বন্ধু বাহারছড়া নোয়াখালী পাড়ায় বেড়াতে আসলে তারাও অপহরণের শিকার হয়। পরে দাবিকৃত ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিতে না পারায় তাদেরও হত্যা করে অপহরণকারীরা। এ পর্যন্ত বাহারছড়া থেকে ৭০-৮০ জনের অধিক লোক অপহরণের কবলে পড়ে প্রত্যেককে মুক্তিপণের টাকা দিয়ে ফেরত আসতে হয়েছে।

দিনের পর দিন যেভাবে অপহরণের ঘটনা বেড়েই চলছে, সাধারণ মানুষ এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে পারে না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বিভিন্নভাবে হুমকিদমকি দেয়া হয় বলে উল্লেখ করেন এ ইউপি সদস্য।

হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের বিভিন্ন পেশার দেড় শতাধিক মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে। তারা প্রত্যেকে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছেন। দিনের পর দিন যেভাবে অপহরণের ঘটনার বাড়ছে এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীরা বাড়ি ফিরতেও ভয় পায়। একদিকে অপহরণ আতঙ্ক, অপরদিকে তাদের জীবিকাণ্ড উভয় সংকটে কষ্টে দিনযাপন করছেন সাধারণ মানুষ।

হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, দিন দিন অপহরণের ঘটনা বাড়ায় কৃষকসহ পাহাড়ি এলাকায় বসবাসরতরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনি জানান, মুক্তিপণ দিয়েছে কিনা জানি না। তবে পুলিশ অপহৃতদের উদ্ধারে ধারাবাহিক অভিযান পরিচালনা করে আসছে। রাতে অভিযানে গিয়ে চারজনকে উদ্ধার করা হয়। অন্যজনকে উদ্ধারের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

তিনি আরো বলেন, ইতিমধ্যে অপহৃত অনেককে উদ্ধারসহ অপহরণকারী চক্রের অনেক সদস্যকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। পাহাড়ি পথ হওয়ায় সহজে মুভ করাও কষ্টের। এরপরও অপহরণ চক্রকে গ্রেপ্তারে মাঠে কাজ করছে গোয়েন্দা ও পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত