আজ থেকে শুরু হচ্ছে সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে মধু সংগ্রহের মৌসুম। তাই আগে-ভাগেই নৌকা সাজানোর কাজ শেষ করতে ব্যস্ত সময় পার করেন মৌয়ালরা। বুড়িগোয়ালিনী স্টেশন ও কদমতলা স্টেশনের আওতাধীন প্রায় ২ হাজার মৌয়াল সুন্দরবনের মধু আহরণে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। দুই মাসের জন্য তারা জীবিকার সন্ধানে সুন্দরবনে মধু আহরণের সুযোগ পাচ্ছেন। এজন্য মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে বনে যাওয়ার জন্য নৌকা মেরামত ও রঙের কাজসহ শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এখন শুধু বন বিভাগের অনুমোদনের অপেক্ষা।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী, নীলডুমুর, দাতিনাখালী, মুন্সীগঞ্জ, গাবুরা, কদমতলা এলাকা ঘুরে মৌয়ালদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবনে যাওয়ার শেষ সময়ের প্রস্তুতি সারলেও আশানুরূপ মধু পাওয়া নিয়ে সংশয়ের কথা জানিয়েছেন ওইসব এলাকার মৌয়ালরা। তবে অভিযোগ মৌসুম শুরুর আগেই সুন্দরবনে মধুচোর চক্র প্রবেশ করে অগ্রিম চাক কাটা এবং বৃষ্টি কম হওয়ার কারণে অন্য মৌসুমের চেয়ে মধু অনেক কম পাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে উপকূলীয় অঞ্চলের মৌয়ালদের মধ্যে।
বুড়িগোয়ালিনী সিরাজুল ইসলাম, দাতিনাখালী গ্রামের মৌয়াল আব্দুল হক ও গাবুরার সোরা গ্রামের মৌয়াল রফিকুল সরদার জানান, ১ এপ্রিল তারা পাস নিয়ে বনে যাবেন। এরই মধ্যে নৌকা মেরামতসহ সব প্রস্তুতি সেরেছেন তারা। তার নৌকায় আট জন সহযোগী রয়েছেন। এক মৌসুমে মধু আহরণ করতে গিয়ে একেক জন মৌয়ালের খরচ হয় ১২ থকে ১৫ হাজার টাকা। তবে বন থেকে মাছ ও কাঁকড়া শিকারের আড়ালে চুরি করে আগাম চাক থেকে মধু কেটেছে মধুচোর চক্র। অন্যদিকে এবার বৃষ্টি নেই। তাই মধু কেমন হবে, তা বলা যাচ্ছে না। কারণ, বনে ফুলের সমারোহ বেশি থাকলেও বৃষ্টি না হওয়ায় তা ঝরে যাচ্ছে। আর ফুল টিকে না থাকলে মধুও কম হয় বলে তিনি জানান।
তারা আরো জানান, সুন্দরবন থেকে তারা মধু আহরণ করছেন ২৫ বছর আবার কেউ ২৬ বছর ধরে। এ বছর মাছ ও কাঁকড়া শিকারের আড়ালে প্রচুর বনজীবী সুন্দরবনে থেকে আগেভাগে চোরাইভাবে মধু কেটেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার মধু অনেক কম পাওয়া যেতে পারে।
মৌয়ালদের অভিযোগ, আগে বন বিভাগ তিন মাস (এপ্রিল, মে ও জুন) মধু আহরণের অনুমতি দিত। কিন্তু গত দুই বছর শুধু এপ্রিল ও মে মাসে মধু আহরণ করতে দিচ্ছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের প্রায় অর্ধেক এলাকায় মধু আহরণের অনুমতি দেয় না বনবিভাগ। এ কারণে আগের চেয়ে মধু আহরণের পরিমাণ কমে গেছে। পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ কার্যালয় থেকে জানা গেছে, সুন্দরবন থেকে আহরণ করা মধুর অধিকাংশই সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ হয়েছিল ১৪১৯ দশমিক ৫০ কুইন্টাল। ২০১৯-২০ অর্থবছরে হয়েছিল ২০০৬ দশমিক ৬০ কুইন্টাল। ২০২০-২১ অর্থবছরে মধু সংগ্রহ হয়েছিল ২১৫৯ দশমিক ১৫ কুইন্টাল। ২০২১ সালের মধু ও মোম আহরণের জন্য ১ হাজার ১২টি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। তারা আরো জানান, ২০২২ সালে ৪১১টি পাস নিয়ে দুই হাজার ৮৯৮ জন মৌয়াল ১ হাজার ৪৪৯ কুইন্টাল মধু এবং ৩৩৪ দশমিক ৭০ কুইন্টাল মোম আহরণ করেন। এ থেকে রাজস্ব আয় হয় ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ৭০০ টাকা। ২০২৩ সালের মধু ও মোম আহরণের জন্য ৩৬৫টি অনুমতিপত্র (পাস) দেওয়া হয়। এসব অনুমতিপত্রের বিপরীতে দুই হাজার ৪৫০ জন মৌয়াল সুন্দরবনে যান। তারা ১ হাজার ২২৫ কুইন্টাল মধু ও ৩৬৭ দশমিক পাঁচ কুইন্টাল মোম আহরণ করেন। আর এ থেকে ২৭ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা সরকারের রাজস্ব আসে। চলতি মৌসুমে এক হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু এবং ৪৫০ কুইন্টাল মোম আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বনবিভাগ সূত্র জানায়, সুন্দরবনের নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাস (অনুমতি) নিয়ে জেলেদের ছদ্মবেশে মধুচোর চক্র প্রবেশ করছে। মৌসুমের আগেই বনে ঢুকে চুরি করে তারা ৪০ থেকে ৫০ ভাগ মধু আহরণ করে ফেলছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা চুরি করে মধু সংগ্রহ ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছেন বলে স্বীকারও করেছেন। লোকবল সংকটের কারণে সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় মধু চুরি ঠেকাতে পারছেন না বলে দাবি তাদের। সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী রেঞ্জ কর্মকর্তা নূরুল আলম জানান, ১ এপ্রিল থেকে মধু আহরণ শুরু হয়। প্রতিটি নৌকায় সর্বোচ্চ ১০ জন মৌয়ালি অবস্থান করতে পারবেন। একজন মৌয়ালি ১৫ দিনের জন্য সর্বোচ্চ ৫০ কেজি মধু ও ১৫ কেজি মোম আহরণ করতে পারবেন। ১৫ দিনের বেশি কোনো মৌয়ালি সুন্দরবনে অবস্থান করতে পারবেন না। এ বছর ১ হাজার ৫০০ কুইন্টাল মধু এবং ৪৫০ কুইন্টাল মোম পাওয়ার আশা করছে বন বিভাগ।