দাবি আদায়ে অনড় বুয়েট শিক্ষার্থীরা
টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ঢাবি প্রতিনিধি
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসে গত বুধবার মধ্যরাতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রবেশের প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা শুক্রবার থেকে বিক্ষোভ, অবস্থান ও ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করে আসছেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সকাল ৭টা থেকে তাদের বুয়েট শহীদ মিনারে জড়ো হওয়ার কথা ছিল। পরে অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেন তারা। যদিও ঘোষণা অনুযায়ী, টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন অব্যাহত রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। চলমান এই আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া দিয়েছেন বুয়েটের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বুয়েটের ২০তম ব্যাচের টার্ম ফাইনাল পরীক্ষায় ১ হাজার ২১৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন মাত্র একজন শিক্ষার্থী। কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই নিয়মিত শিক্ষার্থীদের একজন বাদে সব শিক্ষার্থীই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত ছিলেন। শিক্ষার্থীদের এমন সুদৃঢ় অবস্থান ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে বলে মনে করেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটি দাবি করেন তারা। সংবাদ সম্মেলনে বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। লিখিত বক্তব্যে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একজন মুখপাত্র বলেন, আমরা সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি ভুল প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য। আমরা শপথ করছি সকল রাজনৈতিক ও নিষিদ্ধ সংগঠন থেকে বুয়েটকে মুক্ত রাখার। আমরা আবরার ফাহাদ ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না।’ সংবাদ সম্মেলনে, রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস, অপশক্তির কবল থেকে মুক্ত থাকা এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে তবেই অনতিবিলম্বে একাডেমিক কার্যক্রমে ফেরত যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন শিক্ষার্থীরা। নিরাপত্তা শঙ্কায় গতকালের অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেন বলে জানান তারা। শিক্ষার্থীদের দাবি, নিরাপত্তাজনিত তীব্র শঙ্কার কারণে কেউ কোনোরূপ সমাগম করেনি। বুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরেও শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। নিরাপত্তাজনিত এসব কারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আজ (গতকাল) ক্যাম্পাসে অবস্থান না নেওয়া মানে এই নয় যে বুয়েট শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্র রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাস এর দাবি থেকে সরে এসেছে, এ দাবি বুয়েটের সকল ব্যাচের সকল শিক্ষার্থীর।
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের অভিযোগ : আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্নভাবে ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টরা গুজব ও অপপ্রচারের চালাচ্ছে বলে অভিযোগ করলেন ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল গণমাধ্যম পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে শিক্ষার্থীরা দাবি করেন, ‘সম্প্রতি মিডিয়ায় বুয়েটের আন্দোলনরত বিপুলসংখ্যক সাধারণ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সংশ্লিষ্টরা। আমরা আবারও সাফ জানিয়ে দিতে চাই আমাদের অবস্থান কেবল বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নয়।’
‘বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ায় এখানে শিক্ষার্থীরা যেকোনো রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মকাণ্ডের বিরোধী। এ কারণে ক্যাম্পাসের ভেতরে রাজনৈতিক চর্চায় জড়িতদের বিরোধিতা করে আসছে। বুয়েটের বাইরে বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য তাদের শাস্তি চাওয়া হচ্ছে না বরং তাদের শাস্তি চাওয়া হচ্ছে ওই দিন রাতে ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় নিয়ম অমান্য করে বুয়েটের ভেতরে রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে অনুপ্রবেশ করার জন্য।’
এদিকে ‘মৌলবাদী গোষ্ঠীর কালো ছায়া থেকে মুক্ত করে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতির দাবিতে এবং বুয়েট কর্তৃক গৃহীত অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার-পরিপন্থি ও শিক্ষাবিরোধী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে’ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। সমাবেশ থেকে বুয়েটে নতুন করে ছাত্র রাজনীতি চালুর পাশাপাশি বুয়েট হল থেকে বহিষ্কার হওয়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইমতিয়াজ রাহিম রাব্বির বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়ার দাবি জানিয়ে বুয়েট প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হয়।
সমাবেশে বুয়েটের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, আবরারের লাশের ওপর ভর করে আজকে আপনারা মৌলবাদী গোষ্ঠীর বীজ বপন করার চেষ্টা করছেন। আবরার আপনাদের কাছে ভাই নয়। আবরারের মৃত্যু এই জঙ্গিবাদী শক্তির হৃদয়ে কোনো বেদনার উদ্ভব করেনি। আবরার স্রেফ একটি পলিটিক্যাল ক্যাপিটাল।
বুয়েট প্রশাসনের উদ্দেশে সাদ্দাম বলেন, বুয়েট কি পাকিস্তান যে ভিসা, পাসপোর্ট দিয়ে প্রবেশ করতে হবে? আমি অনেকবার বুয়েটে গিয়েছি। অনেকেই এটাকে অনুপ্রবেশ বলার চেষ্টা করছে। বুয়েটের ছোট ভাই, বন্ধুদের সাথে কথা বলেছি। সেদিনও আমার দাঁড়ানোর কথা ছিল না। যাওয়ার সময় আমার পরিচিত কয়েকজনের সাথে কথা বলার জন্য শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়াই। বৃষ্টি আসার কারণে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে যাত্রা করেছি। এটির জন্য কি পারমিশন নিতে হবে? শুধু বুয়েট কেন পৃথিবীর যেকোনো প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে।
আন্দোলনরত বুয়েট শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, ছাত্র রাজনীতির কিছু নেগেটিভ দিক রয়েছে। আপনারা বলেন ছাত্র রাজনীতিতে ভাই কালচার রয়েছে, গেস্ট রুম কালচার রয়েছে। আপনারা আসুন, ছাত্র রাজনীতি করুন। আপনারা ছাত্র রাজনীতির স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করুন, কীভাবে ছাত্র রাজনীতি করবেন।
সাদ্দাম বলেন, ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার নাটক এই বাংলাদেশ থেকে বন্ধ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, রাজাকারের ফাঁসি চাই স্লোগান তোলার অপরাধে শহীদ হওয়া বুয়েটের শিক্ষার্থী দ্বীপকে আমরা ভুলে যাইনি। কি অপরাধ ছিল তার। তার কণ্ঠে স্লোগান বর্ষিত হতো ক-তে কাদের মোল্লা, তুই রাজাকার তুই রাজাকার। আজ অব্দি আমরা কি সেই সনি হত্যার বিচার হতে দেখেছি? সেই খুনিরা কোথায়, তারা এখন বিদেশে।
তিনি বলেন, একজন আইনের শিক্ষার্থী হিসেবে যে বিষয়টি উল্লেখ না করলেই নয়, বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে- সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে, রাজনৈতিক অধিকার চর্চার সুযোগ সবার রয়েছে, যদি কি না সেটা দেশের বিরুদ্ধে যায়। স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তির চর্চা করা, জাতির পিতার আদর্শের চর্চা করা; এটি কোনো শিক্ষার্থীর অপরাধ হতে পারে না। এই ন্যায্য অধিকার থেকে একজন শিক্ষার্থীকে বঞ্চিত করা সংবিধান পরিপন্থি।
এদিকে সমাবেশ শেষে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম ও সাধারণ সম্পাদক ইনানের নেতৃত্বে দুই শতাধিক নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে বেরিয়ে যান। ছাত্রলীগ ছাত্রলীগের অন্যান্য নেতাকর্মীরা এরপরও বুয়েট শহীদ মিনারে ফুল দেন এবং ছবি তোলেন। তবে তারা কোনো স্লোগান দিতে দেখা যায়নি। এ সময় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রধান গেট বন্ধ করে দেয় বুয়েট প্রশাসন।
এদিকে, গতকাল দুপুরে বুয়েট উপাচার্য ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার জানিয়েছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা চাইলে ক্যাম্পাসে আবারও ছাত্র রাজনীতি চালু করা যেতে পারে। শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে গতকাল বিবৃতি দিয়েছে বামপন্থি ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন।