ডাম্প ট্রাক চাপা দিয়ে ফরেস্টার সাজ্জাদুজ্জামান সজলকে পিষিয়ে হত্যার ঘটনায় পাঁচ দিন হলেও এখনো মূল ঘাতক গ্রেপ্তার হয়নি। যার ফলে বনকর্মীদের মাঝে বাড়ছে আতঙ্ক, উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি ক্ষোভ বাড়ছে পরিবেশবাদী ও সাধারণ মানুষের মাঝে। ফরেস্টার সাজ্জাদের বিচার থমকে গেলে বন রক্ষা করা কঠিন হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহল। এদিকে সহসাই সাজ্জাদ হত্যার মূল ঘাতকদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলে তার সহকর্মী, পরিবেশেবাদী বিভিন্ন সংগঠন আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। তবুও ন্যায় বিচার নিয়ে শংকায় রয়েছে তার সহকর্মী ও পরিবারের লোকজন। গত রবিবার ভোরে উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকায় পাহাড় কেটে মাটি পাচার করছিল একদল বনদস্যু। খবর পেয়ে বন বিভাগের দোছড়ি বিটের কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামানসহ কয়েকজন বনকর্মী ঘটনাস্থলে যান। এ সময় তিনিসহ মোটরসাইকেল আরোহী দুজনকে পাচারকারীদের মাটিভর্তি ডাম্প ট্রাক চাপা দেয়। এতে ঘটনাস্থলে সাজ্জাদুজ্জামান মারা যান। মোহাম্মদ আলী নামের অপর এক বনরক্ষী আহত হন। ৩০ বছর বয়সি নিহত মো. সাজ্জাদুজ্জামান কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া রেঞ্জের দোছড়ি বনবিটের বিট কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মুন্সীগঞ্জ জেলার গজরিয়া উপজেলার মোহাম্মদ শাহজাহানের ছেলে। ঘটনায় ২৭ বছর বয়সি আহত বনরক্ষী মোহাম্মদ আলী টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের ঝিমংখালী এলাকার আবুল মঞ্জুরের ছেলে।
এ ঘটনায় ১০ জনের নাম উল্লেখ করে ১৫ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। এ ঘটনায় এজাহারভুক্ত এক আসামিকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। গত সোমবার (১ এপ্রিল) বনবিভাগের উখিয়ার রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো. শফিউল আলম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
আসামিরা হলেন উখিয়া উপজেলার রাজাপালং ইউনিয়নের পশ্চিম হরিণমারা এলাকার মোহাম্মদ কাশেমের ছেলে ও ডাম্পট্রাকটির চালক মো. বাপ্পী (২৩), একই এলাকার সুলতান আহম্মদের ছেলে ছৈয়দ আলম ওরফে কানা ছৈয়দ (৪০) ও তার ছেলে মো. তারেক (২০), রাজাপালং ইউনিয়নের তুতুরবিল এলাকার নুরুল আলম মাইজ্জার ছেলে হেলাল উদ্দিন (২৭), হরিণমারা এলাকার মৃত আব্দুল আজিজের ছেলে ছৈয়দ করিম (৩৫), একই এলাকার আব্দুল আজিজের ছেলে আনোয়ার ইসলাম (৩৫), আব্দুর রহিমের ছেলে শাহ আলম (৩৫), হিজলিয়া এলাকার ঠান্ডা মিয়ার ছেলে মো. বাবুল (৫০), একই এলাকার ফরিদ আলম ওরফে ফরিদ ড্রাইভারের ছেলে মো. রুবেল (২৪) এবং হরিণমারা এলাকার শাহ আলমের ছেলে কামাল উদ্দিন ড্রাইভার (৩৯)।
মামলায় অজ্ঞাতনামা আরও ৫-৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি ছৈয়দ করিম (৩৫)।
উখিয়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শামীম হোসেন বলেন, ফরেস্টার সাজ্জাদ হত্যার ঘটনায় রেঞ্জ কর্মকর্তা বাদী হয়ে ১০ জনের নাম উল্লেখসহ ১৫ জনকে আসামি করে থানায় এজাহার দায়ের করেন। পরে পুলিশ মামলাটি নথিভুক্ত করে।
ঘটনার পর থেকে পুলিশ জড়িতদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তারে অভিযান শুরু করেছে। গত সোমবার ভোরে রাজাপালং ইউনিয়নের হরিণমারা এলাকায় অভিযান চালিয়ে এজাহারভুক্ত ৫ নম্বর আসামি ছৈয়দ করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে। মামলার অপর আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ওসি।
নিহত সাজ্জাদের বন্ধু, দক্ষিণ বনবিভাগের হিমছড়ি বনবিট কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান শোভন বলেন, বন বিভাগের মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সঠিকভাবে নিরাপদে দায়িত্ব পালন করতে হলে দক্ষ জনবল বৃদ্ধির প্রয়োজন। সব ইউনিটে আগ্নেয়াস্ত্র, যানবাহনের ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা গেলে দুর্গম ও বিচ্ছিন্ন এলাকাগুলোতে আরো অধিকতর ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে বনকর্মীদের। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সার্বিক বিষয় বাস্তবায়নে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান তিনি। পাশাপাশি সাজ্জাদ হত্যায় জড়িতদের আইনের আওতায় এনে, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার দাবি জানান। আর কারো যেন সজল বা ইউসূফ এর মতো বন রক্ষায় জীবন দিতে না হয় সে জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন এই কর্মকর্তা। কক্সবাজার শহর বাপা’র সভাপতি ইরফান উল হাসান বলেন, সাজ্জাদ একজন দেশপ্রেমিক কর্মকর্তা ছিলেন। সাজ্জাদের মত দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে যদি অপরাধীরা পার পেয়ে যায়, তাহলে এটি হবে ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। এতে বন রক্ষায় বনবিভাগের মনোবল কমবে অন্যদিকে বন ও পাহাড়খেকোদের দুঃসাহস বাড়বে। অতিসত্ত্বর জড়িতদের আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান তিনি।
উখিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা গাজী মো. শফিউল আলম জানান, ফরেস্টার সাজ্জাদের হত্যার বিচারের দাবিতে বনকর্মী, পরিবেশবাদী সহ বিভিন্ন পেশার লোকজনের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবারও উখিয়ার ইনানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, মানববন্ধন হয়েছে এবং চলমান থাকবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, পাহাড় খেকোচক্রের ধরতে নিয়মিত পুলিশের সাথে যোগাযোগ হচ্ছে। পুলিশও তাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছে বলে দাবি করেন এই কর্মকর্তা।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সারোয়ার আলম জানান, কক্সবাজারে সংঘবদ্ধ চক্র বেপরোয়াভাবে পাহাড় কাটা অব্যাহত রেখেছে। সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযানে ক্ষুব্ধ হয়ে পরিকল্পিতভাবে বিট কর্মকর্তা সাজ্জাদুজ্জামান সজলকে হত্যা করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক।
প্রসঙ্গতঃ ২০২০ সালে ফরেস্টার হিসেবে বন বিভাগে যোগ দেন সাজ্জাদুজ্জামান সজল। দোছড়ি বনবিটে গত বছরের শেষ দিকে যোগ দেওয়ার পর থেকেই পাহাড় অধ্যুষিত উখিয়ায় পাহাড় ও বন রক্ষায় প্রায় প্রতিরাতেই অভিযান পরিচালনা করে আসছিলেন তিনি। গত তিন মাসে দুই ডজনের মতো ডাম্পট্রাক জব্দ করে মামলার আওতায় এনে রেঞ্জ অফিসে রেখেছেন তিনি। একরাতে চারটি মাটিভর্তি ডাম্পট্রাক জব্দের ঘটনাও আছে তার। এসব কারণে তার ওপর চরম ক্ষুব্ধ ছিল পাহাড়খেকো চক্র। যার ফলশ্রুতিতে তাকে গাড়িচাপায় হত্যার শিকার হতে হয়েছে বলে মনে করছেন তার সহকর্মীরা