ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে ইরানের হামলার জবাব কীভাবে দেওয়া হবে, সে বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে থেকে চাপের মুখে রয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু। লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের দিকে ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে। এর আগে গত শনিবার ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে তিন শতাধিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে নজিরবিহীন হামলা চালায় ইরান।
সম্প্রতি সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যার প্রতিক্রিয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে তেহরান। দামেস্কে গত ১ এপ্রিলের ওই হামলার পরপরই কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল তারা। তবে শনিবার রাতে হামলায় অংশ নেওয়া ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই প্রায় সবগুলো অস্ত্র গুলি করে ভূপাতিত করেছে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র বাহিনী। ইরানের ছোড়া ড্রোন-ক্ষেপণাস্ত্রের ৯৯ শতাংশই ভূপাতিত করার দাবি করেছে ইসরায়েল। তবে এই হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত আরো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদিকে ইরানের হামলার পর থেকেই চাপে আছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ইরানের হামলার জবাব কিভাবে দেওয়া হবে সে বিষয়ে দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে থেকে তার ওপর চাপ বাড়ছে। সবকিছু মিলিয়ে বেশ জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকেই নেতানিয়াহুর ওপর চাপ বাড়ছে। একই সঙ্গে তার জোট সরকারের মধ্য থেকে যারা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছেন তারা এই মুহূর্তে তার ওপর চাপ বাড়াচ্ছেন। তারা ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি এবং কঠোর প্রতিক্রিয়া চান। সে কারণে নেতানিয়াহুকে পরবর্তী পদক্ষেপ খুব ভেবে-চিন্তেই গ্রহণ করতে হবে।
ইরানের ওপর আসতে পারে আরো নিষেধাজ্ঞা
ইসরায়েলের ওপর নজিরবিহীন হামলার দায়ে ইরানের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। এই সংঘাত ছড়িয়ে পড়া রোধে এমন পরিকল্পনার করেছে তারা। কেন না, এই হামলার ইস্যু নিয়ে গতকাল ইসরায়েলি যুদ্ধ মন্ত্রিসভায় তৃতীয়বারের মতো বৈঠকে ইরানি হামলার প্রতিক্রিয়া কেমন হবে- সেই সিদ্ধান্তই নেয়ার কথা রয়েছে
গত শনিবার রাতে করা ইরানি হামলায় ইসরায়েলে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কেন না, ইসরায়েল ও তার মিত্ররা বিমান প্রতিরক্ষা এবং পাল্টা ব্যবস্থা ব্যবহার করে অধিকাংশ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। তবে এই হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যে চলমান এই উত্তেজনা কমানোর লক্ষ্যে এবং ইসরায়েলকে ব্যাপক প্রতিশোধ নেওয়া থেকে বিরত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ ইরানের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কঠোর করার কথা জানিয়েছে। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেছেন, আগামী দিনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন কর্মসূচিকে লক্ষ্য করে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি আশা করছে, মার্কিন মিত্ররাও তাদেরকে অনুসরণ করবে। এর আগে, ওয়াশিংটনে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন বলেছিলেন, ইরানের ‘সন্ত্রাসবাদী অর্থায়ন’ ব্যাহত করার সব ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা তাদের রয়েছে। শিগগিরই ইরানের বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার আশা করছেন তিনি।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি ভিডিও কনফারেন্সের পর ব্রাসেলসে বক্তৃতা দেওয়ার সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান জোসেপ বোরেল বলেন, কিছু সদস্য রাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রসারিত করার কথা বলেছে। ব্লকের কূটনৈতিক পরিষেবা এই প্রস্তাব নিয়ে কাজ শুরু করবে।
ইসরায়েলের সামরিক চিফ অব স্টাফ হারজি হালেভি ইরানের হামলার প্রতিক্রিয়া জানানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েলের ভূখণ্ডে ৩০০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র, ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলার ‘প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।’ তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি।
কয়েক দিন আগেই ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে ইরান। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চালানো এই হামলার পর ইসরায়েলও প্রতিশোধ নেওয়ার উপায় খুঁজছে। ইরানের হামলার জবাব দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলি সেনাপ্রধান। এমন অবস্থায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহুকে মাথা ঠান্ডা রাখার আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। গতকাল এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সপ্তাহান্তে ইরানের হামলার পর ‘মাথা ঠান্ডা রেখে জয় করতে’ গত মঙ্গলবার বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। মঙ্গলবার বিকালে নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক। ফোন কলে প্রধানমন্ত্রী সুনাক নেতানিয়াহুকে চলমান পরিস্থিতিতে উত্তেজনা আরো বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সতর্ক করেন।
ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘তিনি (সুনাক) জোর দিয়ে বলেছেন, উত্তেজনার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি কারো স্বার্থে ভালো কিছু নয় এবং এটি মধ্যপ্রাচ্যে নিরাপত্তাহীনতাকে আরও গভীরে নিয়ে যাবে। জয়ের জন্য মাথা ঠান্ডা রাখার সময় এখন।’
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বলেছে, সুনাক ‘ইসরায়েলের নিরাপত্তা এবং বৃহত্তর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য যুক্তরাজ্যের অবিচল সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন’। প্রধানমন্ত্রী সুনাক (নেতানিয়াহুকে) বলেছেন, ইরান গুরুতরভাবে ভুল হিসাব-নিকাশ করেছে এবং বিশ্বমঞ্চে এই দেশটি ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
এছাড়া ইরানের হামলার জেরে বিশ্বমঞ্চে জি-৭ কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় সমন্বয় করছে বলেও জানিয়েছে সুনাকের কার্যালয়।