দুবাই বিমানবন্দরে আকস্মিক বন্যা
২৯০ ফ্লাইট বাতিল ৪৪০টি বিলম্বিত
* আমিরাতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২০ জন * জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার চরম বিপর্যয়
প্রকাশ : ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলোকিত ডেস্ক
রেকর্ড বৃষ্টিপাতের তৃতীয় দিনেও বিপর্যস্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) বেশিরভাগ এলাকা। আকস্মিক বন্যায় বিশেষ করে দুবাই শহরের স্থবিরতা এখনও কাটেনি। বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বিশ্বের দ্বিতীয় ব্যস্ততম দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্যক্রম পুরোপুরি শুরু হয়নি। গত মঙ্গলবারের অস্বাভাবিক ঝড়বৃষ্টির ফলে হঠাৎ বন্যার কবলে পড়েছে ইউএই। পানির নিচে তলিয়ে গেছে দুবাই বিমানবন্দরের রানওয়ে। এর ফলে প্রায় বিমানবন্দরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বেশিরভাগ ফ্লাইট বাতিল, পরিবর্তন ও বিলম্ব করা হয়। ৭৫ বছরের মধ্যে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের নজির দেখা গেল সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট হওয়া বন্যায় দুবাইয়ের বেশিরভাগ রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় দেখা দিয়েছে যানজট। অফিস ও বাড়িতে আটকা পড়েছে বেশিরভাগ মানুষ। ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জলবায়ু বিজ্ঞানী কলিন কোলজা বলেছেন, মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এ ধরনের বৃষ্টিপাতকে দায়ী করেছেন।
তবে প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃত্রিম বৃষ্টি ঝরানোর বিষয়টি অস্বীকার করেছে মেঘ তৈরির সাথে জড়িত ইউএইর সরকারি সংস্থা। রবিবার প্রতিবেশী ওমানে আঘাত হানে ঝড়টি। এতে সেখানে দেখা দেয়া বন্যায় অন্তত ২০ জন মারা যায়। ঝড়টি গত মঙ্গলবার ইউএইতে আঘাত হানে। এতে ভেসে যায় দুবাইসহ ইউএইর বেশিরভাগ এলাকা।
মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় দেশগুলো ঝড় ও ব্যাপক ভারি বৃষ্টিপাতের শিকার হয়েছে। এর ফলে প্রাণঘাতী আকস্মিক বন্যার পাশাপাশি বিশ্বের দ্বিতীয়-ব্যস্ততম বিমানবন্দর তথা দুবাই বিমানবন্দরে ফ্লাইট চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বলেছে, তারা ‘খুবই চ্যালেঞ্জিং অবস্থার’ সম্মুখীন হয়েছে। এছাড়া দুবাইয়ের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় কিছু যাত্রীকে বিমানবন্দর থেকে না যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। আরো উত্তরে, বন্যার পানিতে গাড়ি পড়ে যাওয়ার পর একজন লোক মারা গেছেন। ওমানে উদ্ধারকারীরা সাহামে একটি মেয়ের লাশ খুঁজে পেয়েছেন। এতে করে গত রোববার থেকে দেশটিতে মৃতের সংখ্যা ২০ জনে দাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার ভোর ৩টায় ফ্লাইট অ্যাওয়্যারের ডেটা অনুসারে, দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে প্রায় ২৯০টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি সারা বিশ্বের যাত্রীদের জন্য ব্যস্ততম এয়ার হাব হিসেবে পরিচিত। ডেটা অনুসারে, ওই একই সময়ে আরো ৪৪০টি ফ্লাইট বিলম্বিত ছিল। বিমানবন্দরটি গত বছর ৮০ মিলিয়নেরও বেশি যাত্রীদের পরিষেবা দিয়েছে এবং যাত্রী পরিষেবার দিক থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টার পরই দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সতর্ক করে বলেছে, পরিষেবা পুনরুদ্ধারে আরো ‘কিছু সময়’ লাগবে। এছাড়া বিমানবন্দর থেকে দেওয়া সর্বশেষ আপডেটে এয়ারলাইন্স থেকে নিশ্চিতকরণ ছাড়া ১নং টার্মিনালে যাওয়া এবং বিমানবন্দরে ভ্রমণ এড়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম প্রধান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন হচ্ছে এমিরেটস। এই সংস্থাটির সদর দপ্তরও দুবাইয়ে এবং বৃহস্পতিবার পর্যন্ত জনপ্রিয় এই পর্যটন শহর থেকে ছেড়ে যাওয়া যাত্রীদের জন্য চেক-ইন স্থগিত করেছে তারা। কর্তৃপক্ষ সতর্ক করেছে, আরও বজ্রপাত, ভারি বৃষ্টি এবং শক্তিশালী বাতাসের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, অনেক নিচু এলাকা এখনো পানির নিচে রয়েছে।
৭৫ বছর আগে রেকর্ড রাখা শুরু হওয়ার পর থেকে ওমানের উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী সংযুক্ত আরব আমিরাত গত মঙ্গলবার সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত প্রত্যক্ষ করেছে। ন্যাশনাল সেন্টার অব মেটিওরোলজি ঘোষণা করেছে, ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আল-আইন অঞ্চলের খাতম আল-শাকলায় ২৫৪.৮ মিমি বৃষ্টিপাত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটিতে বছরে গড়ে ১৪০-২০০ মিমি বৃষ্টিপাত হলেও দুবাইয়ে বছরে সাধারণত মাত্র ৯৭ মিমি বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। আর এপ্রিল মাসের মাসিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ প্রায় ৮ মিমি।
গত মঙ্গলবার ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে এই বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা বিপজ্জনক হওয়ার কারণে অসংখ্য আগত ফ্লাইট সরিয়ে নিতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। মূলত ঝোড়ো বাতাসের কারণে বিমানবন্দরটিতে ফ্লাইট ওঠানামায় বিঘ্ন ঘটে। এই অবস্থায় একের পর এক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট হয় বাতিল, নয়তো তার শিডিউল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয় বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের ভেতরেই প্লাবিত রানওয়েতে বিমানগুলো ট্যাক্সি করছে। এছাড়া বিমানবন্দরের পার্কিং লটে গাড়িগুলোকে অর্ধেক ডুবে থাকতে দেখা গেছে। এমনকি বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার রাস্তাগুলোও পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এছাড়া দুবাই মল এবং মল অব দ্য এমিরেটসের মতো ফ্ল্যাগশিপ শপিং সেন্টারসহ শহরের মূল অবকাঠামোগুলোও প্লাবিত হয়েছে এবং দুবাইয়ের অন্তত একটি মেট্রো স্টেশনকে গোড়ালি-গভীর পানিতে প্লাবিত হতে দেখা গেছে।
অনেক স্থানে রাস্তা ধসে পড়েছে, আবাসিক এলাকাও নিমজ্জিত হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে বাড়ির ছাদ, দরজা এবং জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সেইসাথে দুবাইয়ে ১২-লেনের মহাসড়কের কোথাও কোথাও দীর্ঘ যানজটও দেখা গেছে। বিমানবন্দরে সম্পূর্ণরূপ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। লোকজন লাউঞ্জে, মেঝেতে ঘুমাচ্ছে এবং খাবারের প্যাকেট সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বিমান যাত্রীরা বলছেন, এটি বিপজ্জনক এবং অমানবিক। সঠিক খাবার ও পানির সংকটের অভিযোগ করেছেন আটকা পড়া যাত্রীরা।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির সঙ্গে প্রবল বজ্রঝড়ও আঘাত হেনেছে দেশটিতে। সেখানে দেড় বছরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয় মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারচেয়েও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া দুবাই শহরের প্রধান প্রধান সড়ক এবং এর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।
দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সংগৃহীত আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সময় গত সোমবার রাত থেকেই সেখানে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে দুবাইয়ের রাস্তা-ঘাট তলিয়ে যায়। এছাড়া মঙ্গলবার সকাল ৯টায় ঝড়ের তীব্রতা বাড়তে থাকে এবং সারা দিন ধরেই ঝড় বয়ে গেছে। গত মঙ্গলবারের শেষের দিকে ১৪২ মিমি (৫ দশমিক ৫৯ ইঞ্চি)-এরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। গড়ে বছরে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৯৪ দশমিক মিমি (৩ দশমিক ৭৩ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত হয়। প্রবল বৃষ্টিতে বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দরটির রানওয়ে থেকে শুরু করে বিমানবন্দরে ঢোকার রাস্তা, গাড়ি পার্কিংয়ের এলাকা সবই পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে বিমানের ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়। পুরো শহরই যেন থমকে গেছে। দুবাইয়ে ভারি বৃষ্টি খুব একটা হয় না। সে কারণে স্বাভাবিক ভাবেই এ ধরনের দুর্যোগ খুব একটা দেখা যায় না। তবে হঠাৎ করেই ভারি বৃষ্টিতে দেশটি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিশ্ব উষ্ণায়ণ এবং তার সার্বিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। বিশ্বের অনেক দেশেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার চরম বিপর্যয় শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বহু বিমানের গতিপথ অন্যত্র ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে বিমানবন্দরে এক রাতেই অন্তত কয়েকশ বিমান ওঠানামা করে, সেখানে ২৫ মিনিট পুরো কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েন বহু যাত্রী। সামাজিক মাধ্যমে বেশ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা গেছে রানওয়েতে পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে থাকা রানওয়ে দিয়েই এগিয়ে চলেছে বিমান। অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের বাইরের রাস্তাতেও পার্কিং লটেও পানিতে তলিয়ে গেছে বিভিন্ন যানবাহন। সূত্র : ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।