নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রে ভোটো

আটকে গেল জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ

অনিশ্চয়তায় স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

জাতিসংঘে রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ পাওয়ার পথ আটকে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার নিরাপত্তা পরিষদে এ সংক্রান্ত প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটিতে ভেটো দিয়েছে দেশটি। খসড়া প্রস্তাবটিতে ফিলিস্তিনকে জাতিসংঘের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে ১৯৩ সদস্যের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছিল। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের ১২টি এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল। ভোটদানে বিরত ছিল যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ড। ভেটো প্রদান করে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ভেটো না পড়লে প্রস্তাবটি পাস হতে ৯ ভোটের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া ও চীন, এ স্থায়ী পাঁচ সদস্যের কোনো একটি দেশ বিপক্ষে ভোট দিলে ওই প্রস্তাব আর গৃহীত হয় না। ফিলিস্তিন বর্তমানে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক সদস্য হিসেবে রয়েছে। ২০১২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে কার্যত রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছিল ফিলিস্তিন। তবে পূর্ণ সদস্যপদ পেতে নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমোদন প্রয়োজন। অবশ্য সাধারণ পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য এরই মধ্যে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের মধ্যে সরাসরি আলোচনার মাধ্যমে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়া উচিত, জাতিসংঘের মাধ্যমে নয়। যদিও গত কয়েক বছর ধরে ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা বন্ধ রেখেছে ইসরায়েল। এমন সময় জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছে ফিলিস্তিন, যখন ছয় মাস ধরে গাজায় হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। একই সঙ্গে দখলকৃত পশ্চিম তীরে বসতিস্থাপন বিস্তৃত করছে দেশটি।

এর আগে নিরাপত্তা পরিষদে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, সাম্প্রতিক উত্তেজনা ইসরায়েল এবং একটি সম্পূর্ণ স্বাধীন, কার্যকর ও সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মধ্যে স্থায়ী শান্তি খোঁজার সদিচ্ছা আছে এমন প্রচেষ্টাকে সমর্থন করাটাকে আরো গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আরো বলেন, দুই রাষ্ট্র সমাধানে অগ্রগতি সাধনে ব্যর্থতা শুধুই অস্থিরতা এবং এই অঞ্চলজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জন্য ঝুঁকিই বাড়াবে, যারা অব্যাহত সহিংসতার হুমকির মধ্যে বসবাস করতে থাকবে। আরব-ইসরায়েলের মধ্যে ১৯৪৮ সালের যুদ্ধের পর থেকে ফিলিস্তিনে যে যুদ্ধ শুরু, সেটা চলছে এখনো। ৫০ বছর আগে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর আরব দেশগুলোর সঙ্গে আর কোনো যুদ্ধ না হলেও ফিলিস্তিন-ইসরায়েল দ্বন্দ্ব-সংঘাত বন্ধ হয়নি। যদিও সংঘাত বন্ধে শান্তির ফর্মুলা হিসেবে বিভিন্ন সময় দুই রাষ্ট্র সমাধানের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু সেটা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের সমাধান প্রথম এসেছিল ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘের মাধ্যমে। ওই সময় বলা হয়, ইসরায়েল হবে ইহুদিদের জন্য এবং ফিলিস্তিন আরবদের জন্য। তবে ইহুদিরা মোট ভূখণ্ডের ১০ শতাংশের মালিক হলেও তাদের দেয়া হয় মোট জমির অর্ধেক। যেটা আরবরা মানেনি।

এরই ধারাবাহিকতাতেই হয় প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। কিন্তু একটা সময়ে এসে ঠিকই ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন উভয়পক্ষই দুই রাষ্ট্র সমাধানে ঐকমত্য হয়। কিন্তু সেটা কীভাবে হলো? এবং পরে কেন আবার ব্যর্থও হলো সেটা একটা বড় প্রশ্ন। ফিলিস্তিন এবং ইসরায়েল পৃথক দুটি রাষ্ট্রের ধারণা প্রথমবারের মতো বাস্তবতার দিকে এগোতে শুরু করে ১৯৯৩ সালে নরওয়ের অসলোতে ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। যেটা এলো অ্যাকর্ড নামে পরিচিতি। এই চুক্তিতে পশ্চিম তীর এবং গাজায় সরকার পরিচালনার জন্য একটি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠনের কথা বলা হয়। এটা গঠনের সময়সীমা ছিলো ৫ বছর। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা স্বীকার করে নেয় ইসরায়েল রাষ্ট্রকে। চুক্তি অনুযায়ী অবশ্য খুব দ্রুতই পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকা নিয়ে সম্ভাব্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের একটি কর্তৃপক্ষও গঠন করা হয়। কিন্তু তারপরই শান্তি প্রক্রিয়া ধীর হয়ে যায়। নানারকম বাধা তৈরি হয়। দুই রাষ্ট্র সমাধান মেনে নেয়া হলেও সেই রাষ্ট্র কবে গঠন হবে, তার কোনো সময়সীমা বেধে দেয়া হয়নি। এমনকি ইসরায়েলের বাইরে আলাদা একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চারটি বিষয়েরও কোনো সমাধান করা হয়নি। এই চারটি বিষয় হচ্ছে-

প্রথমত: দুই রাষ্ট্রের সীমান্ত কোথায়, কীভাবে নির্ধারণ হবে সেটা। দ্বিতীয়ত: জেরুজালেম কার অধীনে থাকবে। তৃতীয়ত: ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের ভেতরে থাকা ইসরায়েলি বসতিস্থাপনকারীদের কীভাবে সরিয়ে নেয়া হবে এবং চতুর্থত: ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ইসরায়েলের ভেতরে থাকা যেসব ফিলিস্তিনি বাস্তচ্যুত হয়েছেন, তারা ইসরায়েলে কিভাবে ফিরবেন। চুক্তিতে বলা হয়েছিল, ৫ বছরের মধ্যে একটি ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষ গঠনের পর এগুলো আলোচনার ভিত্তিতে পরে ঠিক করা হবে। কিন্তু সেটা আর কখনোই হয়নি। ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডল ইস্টার্ন স্টাডিজের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক বলছেন, চুক্তি বাস্তবায়ন না হবার পেছনে দুই পক্ষেরই দায় ছিল। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ‘ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন- দুই পক্ষেই চুক্তিবিরোধী শক্তিশালী দুটি গ্রুপ ছিল, যারা এই ঐকমত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ, দুই পক্ষই বলছিল পুরো এলাকা তাদের এবং শুধু তাদেরই রাষ্ট্র হবে। ফিলিস্তিনে এটা ছিল হামাস এবং ইসলামি জিহাদ। আর ইসরায়েলে ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী গ্রুপগুলো। ফলে অসলো অ্যাকর্ড আর এগোয়নি।’

কিন্তু ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির পরপরই এর বিরোধিতায় হামাস এবং ইসলামিক জিহাদ ইহুদিদের ওপর হামলা শুরু করে। অন্যদিকে ইসরায়েলে একজন ইহুদি কট্টরপন্থির হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন শান্তিচুক্তি করা দেশটির প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিন। এরপর ১৯৯৬ সালে ইসরায়েলে ডানপন্থিরা ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের সরকারও আর শান্তি প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে চায়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে বিভিন্ন সময় দুই পক্ষের বৈঠক হলেও সমাধান আসেনি। এ সময় ইসরায়েল মূলত: নজর দিয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের ওপর এবং জেরুজালেমকে তারা ইসরায়েলের রাজধানীও ঘোষণা করেছে। সবমিলিয়ে ফিলিস্তিনে এখন যে ভৌগোলিক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, তাতে করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র বাস্তবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব কি না, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই সন্দেহ রয়েছে।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য সবার আগে দরকার ভূখণ্ড। কিন্তু পশ্চিম তীর যেটা কি না, ফিলিস্তিনের অংশ হবে সেখানে এখন কয়েক লাখ ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বসবাস করছেন। এছাড়া জেরুজালেমকেও ইসরায়েল তার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং আমেরিকা সেটাকে স্বীকৃতিও দিয়েছে। ফলে ভৌগোলিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন এখন আর বাস্তব সম্মত নয় বলেই অনেকে মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক গবেষক শাহিন বেরেনজি মনে করেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা খুবই চ্যালেঞ্জিং হবে।

বিবিসি বাংলাকে তিনি বলছিলেন, ‘এটা বাস্তবায়ন করা ১৯৯০ এর দশকের তুলনায় খুবই কঠিন। কারণ, পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমের ইহুদি বসতি। ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির সময় এটা ছিল ১ লাখ ২০ হাজার। গেলো তিন দশকে ইহুদি বসতিস্থাপনকারী বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ। এছাড়া খোদ ইসরায়েলের আইন অনুযায়ীই অবৈধ এরকম ইহুদি বসতিও আছে।’

তিনি মনে করেন, এ রকম বসতি সম্প্রসারণ এবং ইসরায়েলের রাজনীতিতে এর প্রবল সমর্থনের কারণে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন কঠিন হয়ে পড়েছে। ‘তাছাড়া দুই রাষ্ট্র সমাধানের প্রতিও এখন আর ইসরায়েলের আগ্রহ নেই। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরাও হামাস এবং ফাতাহ দুই দলে বিভক্ত। এবং তাদের মধ্যে ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কথা বলা বা শান্তি প্রক্রিয়া এগুনোর মতো একক এবং বিশ্বস্ত নেতা নেই’ বলেন তিনি। ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেইর লিটভ্যাক অবশ্য বলেছেন, সুযোগ এখনো আছে। কিন্তু ইসরায়েল কি দুই রাষ্ট্র সমাধান আর চায়? লিটভ্যাক বলেছেন, ইসরায়েল সেটা চায় না। ‘আমি এখানে ইসরায়েলের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করি। তারা যেটাকে সমাধান মনে করে সেটা হচ্ছে, পরিস্থিতি যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকুক। অর্থাৎ, তারা পশ্চিম তীরকে নিয়ন্ত্রণ করবে, যেখানে আবার একটা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও থাকবে। তবে দুর্বল এবং ইসরায়েলের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু চিরদিন ইসরায়েল এভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবে, এটা একটা ভুল ধারণা। এটা থেকে বেরিয়ে এলে সমাধান সম্ভব’ বলেছেন লিটভ্যাক। লিটভ্যাক মানছেন ইহুদি বসতি একটা বড় সমস্যা। কিন্তু তিনি এটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ইসরায়েল এর আগে গাজা থেকে তাদের সব বসতি সরিয়ে নিয়েছিল এবং নিজেরাও গাজার নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়েছে। সুতরাং, কঠিন হলেও পশ্চিম তীরে সেটা করা যাবে। এমনকি জেরুজালেম নিয়েও দুই পক্ষ ছাড় দিলে ঐকমত্যে আসা সম্ভব। কিন্তু ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিনের মধ্যে এখন যে নতুন যুদ্ধাবস্থা, সেখানে যুগের পর যুগ ধরে চলে আসা অচলাবস্থার পরিবর্তন কে করবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। মার্কিন গবেষক শাহিন বেরেনজি মনে করেন, এখানে আমেরিকাকেই আবার এগিয়ে আসতে হবে। তার মতে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তির উদ্যোগ নিলে সেটা সফল হতে পারে।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে আমেরিকা যখন মধ্যপ্রাচ্যে কিছু করতে চেয়েছে, তখন সেটার বাস্তবায়নও হয়েছে। মিশর-ইসরায়েল শান্তিচুক্তি, জর্ডানের সঙ্গে চুক্তি এমনকি সাম্প্রতিককালে আব্রাহাম অ্যাকর্ড’র সবগুলোর পেছনে আমেরিকার ভূমিকা আছে।’ কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে আমেরিকার আগ্রহ আছে কি না- এমন প্রশ্নে মি. শাহিন বলেছেন, ‘দুই যুগ আগে নাইন-ইলেভেনের পর আমেরিকার চোখ এলো শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন থেকে সরে যায় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। সেটা শেষ হলে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইরান, রাশিয়া, চীন নিয়ে। কিন্তু এখন আমেরিকাকে আবারো মধ্যপ্রাচ্যে সক্রিয় হতে হচ্ছে। কারণ এখানে অবহেলা করলে এর ফল সবাইকেই ভোগ করতে হবে, কিছু সময় পর পর সংঘাত সামনে আসবে। আমেরিকা শান্তির উদ্যোগ নিলে হয়তো সেটা আশা দেখাতে পারে। কিন্তু এখন ইসরায়েল-গাজা সংকট যে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের দিতে এগোচ্ছে, সেখানে আমেরিকা-ইসরায়েল কিংবা হামাস, শান্তির কথা কেউই বলছে না; সংকটটা এখানেই।