‘আওরঙ্গজেব মাতবর, মোহাম্মদ আজমগীর মাতবর তারা আপন দুই ভাই। একজন কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। অন্যজন স্থানীয় কৈয়ারবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তাদের দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায় রয়েছে একটি সংঘবদ্ধ পারিবারিক বাহিনী। তাদের কথামতো না চললে হামলা, মামলার শিকার হতে হয় স্থানীয়দের। এমনকি তাদের হামলা থেকে রেহাই পায়নি সাংবাদিক, আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযোদ্ধা। অনেকেটা এই উপজেলার বাসিন্দারা জিম্মি হয়ে পড়েছে তাদের সংঘবদ্ধ পরিবারের কাছে। বলতে গেলে দুই ভাইয়ের ক্ষমতার দাপটে তটস্থ দ্বীপবাসী। তাদের অদৃশ্য ক্ষমতার কারণে কেউ মুখ খুলতে সাহস করে না। দুই ভাইয়ের কারণে পরিবারের অন্য সদস্যরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তাদের ক্ষমতার দাপটে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রশাসনও অনেকটা তটস্থ। তারা হামলা করলেও মামলা না নেয়ার অভিযোগ রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে। গত শুক্রবার সাংবাদিকের উপর হামলার ঘটনায় গতকাল শনিবার কুতুবদিয়া থানা পুলিশ মামলা রেকর্ড করলেও রয়েছে নানা অসঙ্গতি। প্রকাশ্যে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হলেও সংশ্লিষ্ট ধারা বাদ দিয়ে মামলাটি রেকর্ড করে পুলিশ। ওই মামলায় কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবরকে প্রধান আসামি করে অজ্ঞাতসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। রেকর্ডকৃত মামলায় অসঙ্গতি এবং ২৪ ঘণ্টায়ও অপরাধীদের আটক না করায় সাংবাদিক মহলের মাঝে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ক্ষোভ প্রকাশ করে ‘রিপোর্টার্স ইউনিটি কক্সবাজারের সভাপতি এইচএম নজরুল ইসলাম বলেন, কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবরের নেতৃত্বে হামলার শিকার হয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিন ও এশিয়া টেলিভিশনের কুতুবদিয়া উপজেলার প্রতিনিধি সাংবাদিক মিজানুর রহমান যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও নিন্দনীয় ঘটনা। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলায় গুরুত্বর আহত সাংবাদিক মিজানুর রহমানের মামলা নিতেও কুতুবদিয়া থানা অনেক গড়িমসি করেন বলে অভিযোগ ওঠে যা কখনো কাম্য ছিল না। দিন শেষে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারা কাটছাঁট করে মামলা রুজু হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। সাংবাদিক সমাজ আশা করে দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে প্রকৃত অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনবে।
সূত্র মতে, গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) বিকালে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে এই চক্রটির হাতে হামলার শিকার হন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কুতুবদিয়া উপজেলা প্রতিনিধি মো. মিজানুর রহমান। তার উপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত করেন চক্রটি। প্রকাশ্যে এই হামলায় নেতৃত্ব দেন উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের নজর আলী মাতবর পাড়ার মৃত আবুল কাশেম মাতবরের তিন ছেলে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবর, তার দুই ভাই আজমগীর মাতবর ও মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং তাদের পুত্র আরিফ বিন রিনাস, সানজো রাকিব, মো. মোজাহিদ, মো. নিহাল উদ্দিনসহ অজ্ঞাত আরো ১০-১৫ জন।
আহত সাংবাদিক মিজানুর রহমান বলেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির নেতৃত্বে একটি অসহায় পরিবারে জায়গা দখলের একটি ভিডিও প্রচারে জেরে তার ওপর হামলা হয়। পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় হঠাৎ কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবরের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা এই হামলা চালায়। এরপর তিনি আর কিছু বলতে পারেননি।
তিনি আরও বলেন, তার দেয়া এজাহারটি গতকাল শনিবার মামলা হিসাবে রেকর্ড করেছে। তবে রহস্যজনক কারণে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। তিনি তার নিরাপত্তা ও অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
স্থানীয় সাংবাদিক আব্বাস সিদ্দিকী বলেন, হঠাৎ মিজানুর রহমানের উপর হামলা হচ্ছে দেখে আমরা কয়েকজন মিলে তাকে উদ্ধার করে কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নিয়ে যাই। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে রেফার করেন চিকিৎসক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দখলবাজি, হামলা, মারামারিতে সিদ্ধহস্ত আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। এর আগে তার নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের উপরেও নৃশংস হামলার ঘটনা ঘটে। উপজেলা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ব কব্জা করার পর থেকেই তিনি মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।
তার হাতে দলীয় নেতাকর্মীরাই সবচেয়ে বেশি নিপীড়ন, নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন। এর আগে কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ এলাকায় লবণের মাঠ দখলকে কেন্দ্র করে আওরঙ্গজেব মাতবর গং গ্রুপের গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ১০ জন চাষি গুলিবিদ্ধ হন। ইতিপূর্বে কুতুবদিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আওরঙ্গজেব মাতবরের বিরুদ্ধে ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে তাকে বহিষ্কারের দাবি জানান স্থানীয় নেতাকর্মীরা। ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর কক্সবাজার প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন কুতুবদিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। আওরঙ্গজেব সভাপতির দায়িত্ব পাওয়ার পর এ পর্যন্ত উপজেলা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ের ৭০ নেতাকর্মীকে মারধর করেছেন বলে তারা অভিযোগ করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপজেলার অন্তত ৫০ নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন।
ওই সময় লিখিত বক্তব্যে জানানো হয়, আওরঙ্গজেব মাতবর ১৯৮৭ সালে কুতুবদিয়া উপজেলা ফ্রিডম পার্টির সভাপতি ছিলেন। কুতুবদিয়ায় এক সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেন। পরে ২০১৫ সালে অদৃশ্য শক্তির প্রভাবে তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ দখল করেন।
নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক কয়েকজন ত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতা দাবি করেন, তার হাতে উপজেলা আওয়ামী লীগের ৩২ বছরের সভাপতি প্রয়াত ছৈয়দ আহমদ কুতুবী, সাবেক সভাপতি আহমদ উল্লাহ, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুচ্ছফা বিকম, লেইমশীখালী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিমসহ অন্তত ৭০ নেতাকর্মী মারধরের শিকার হয়েছেন।
তবে ওই সময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওরঙ্গজেব মাতবর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি ১৯৯৪ সাল থেকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের দায়িত্বও পালন করেছি।
গতকাল বিকালে একইভাবে অভিযুক্ত কৈয়ারবিল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আজমগীর মাতবরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত শুক্রবার ঘটনার সময় আমি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সাথে ছিলাম। আমি ঘটনাস্থলে যাইনি। তবুও আমাকে আসামি করা হয়েছে। দুঃখের বিষয় এলাকায় নেই, আমার দুই কলেজপড়ুয়া ছেলেকেও আসামি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আনীত অন্য অভিযোগগুলোও তিনি অস্বীকার করেন।
গতকাল বিকালে কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম কবিরের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সাংবাদিকের উপর হামলার ঘটনায় মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। আসামিদের ধরতে অভিযান চলমান রয়েছে।
রেকর্ডকৃত মামলায় অসঙ্গতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এজাহারে বাহিরে ধারা দেয়ার নিয়ম নেই। যদি মেডিকেল রিপোর্টে ৩২৬ ধারা দেয়ার প্রমাণ আসে পরে তা সংযুক্ত করা হবে।