গত কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এতে জনজীবন রীতিমতো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। রাজধানী ঢাকায় ৪০ ডিগ্রি তাপমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। আগামী দিনে এই তাপপ্রবাহ আরও বাড়বে বলে সতর্ক করে দিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর। অসহনীয় এই গরমে ঘরে-বাইরের কাজ সামলে সুস্থ থাকাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন অনেকে। এ সময় সবচেয়ে বেশি ভয় হিটস্ট্রোক বা সানস্ট্রোকের। তবে হিটস্ট্রোক হওয়ার আগে পূর্বাভাস পাওয়া যায়। সর্তক হতে হয় সে সময়ই। আমাদের শরীরে যে তাপজনিত সমস্যা হয় তাকে বলে তাপ সম্পর্কিত অসুস্থতা। এর ভয়ানক রূপকে বলা হয় হিটস্ট্রোক। এ ব্যাপারে মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলেন, ‘মানুষের শরীরের ভেতরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাইরে যদি ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি থাকে বা তাপমাত্রা শূন্যে নেমে যায় শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৫-ই থাকবে। যে কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর শরীরে তাপমাত্রা রেগুলেট করে মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থি। এজন্য অতিরিক্ত গরমে শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয়ে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়।’ তিনি বলেন, ‘আবার অতি ঠান্ডায় বিভিন্ন হরমোনকে নিয়ন্ত্রণ করে রক্তনালিকে সঙ্কুচিত করে শরীরের তাপমাত্রা বাড়ায়। ফলে বাইরে যতই ঠান্ডা থাকুক, শরীরের ভেতরে তাপমাত্রা ঠিক থাকে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে হাইপোথ্যালামাসের কার্যক্ষমতা কমে গেলে শরীরের ভেতরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কাজ ঠিক মতো হয় না। শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে হার্ট, কিডনি, লিভার বিকল হতে শুরু করে। হার্ট বিট বেড়ে যায়। মাসল ক্র্যাম্প হয়। ব্লাডপ্রেশার কমে যায়। ঘাম কমে যায়, মাথা ঘোরে, কথা অসংলগ্ন হতে পারে, শরীর জ্বরে পুড়ে যাওয়ার মতো গরম হয়ে যায়, এগুলোই হিটস্ট্রোকের আগাম লক্ষণ।’
জ্বর নাকি হিটস্ট্রোক বুঝবেন কীভাবে? হিটস্ট্রোকের আগাম লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, জ্বরের মতো গা গরম হয়ে যাওয়া। তাই অনেকেই সাধারণ জ্বরের সঙ্গে পার্থক্য করতে পারেন না। ফলে চিকিৎসা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। সাধারণ জ্বর হয় শরীরে কোনো ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ঘটলে। ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বেঁচে থাকে। হাইপোথ্যালামাস সেই ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসকে অকেজো করতে শরীরে ভেতরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয়। কলকাতার এই চিকিৎসক বলেন, ‘জ্বর কোনো রোগ নয়, রোগের লক্ষণ। তাই অল্প জ্বর হলে চিকিৎসকরা ওষুধ দিতে চান না। খুব বেশি কষ্ট হলে প্যারাসিটামল দেওয়া হয়। কারণ জ্বর তৈরি হতে না দেওয়া হলে ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসগুলো মরার সম্ভাবনা কমে যায়।’ জ্বর হলেও গা তেতেপুড়ে যায়, যা হিটস্ট্রোকের আগাম লক্ষণ। তা হলে বোঝার উপায় কী, সমস্যা কোনটা? চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলেন, ‘হাইপোথাল্যামাস গ্রন্থির কার্যক্ষমতা কমে গেলে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তখন হয় হিটস্ট্রোক। আর হাইপোথ্যালামাস প্রবল সক্রিয় থেকে ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসের সঙ্গে লড়ার জন্য তাপমাত্রা তৈরি করে।’ টানা রোদে কাজ করলে, ঘরে বা কারখানায় গরমের মধ্যে একটানা কাজ করার পর শরীর তেতেপুড়ে যাওয়ার মতো গরম হলে ধরে নিতে হবে সেটা হিটস্ট্রোকের আগাম সতর্কতা। ব্যাক্টেরিয়া বা ভাইরাসজনিত জ্বর হলে আগে শীত করবে, কাঁপুনিও দিতে পারে। প্রথমটার ক্ষেত্রে দেরি না করে তাকে ছায়ার মধ্যে, পাখার তলায় বা এসি রুমে বসিয়ে যতটা সম্ভব তার পোশাক খুলিয়ে পর্যাপ্ত পানি দিয়ে পুরো শরীর মুছিয়ে দিতে হবে। রোগীর যদি জ্ঞান থাকে তা হলে পানি, ওআরএস স্যালাইন খাওয়ানো যেতে পারে। এতে শরীরের ভেতরের তাপমাত্রা কমবে। কিন্তু আচ্ছন্ন বা অজ্ঞান অবস্থায় থাকলে ঠোঁট ফাঁক করিয়ে পানি বা ওআরএস খাওয়ানো একদমই উচিত নয়। পানি ফুসফুস বা শ্বাসনালিতে ঢুকে গেলে বিপদ বাড়বে। তাই তাড়াতাড়ি নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া দরকার।
ঘরে-বাইরে একই নিয়ম : চিকিৎসকের পরামর্শ, সকাল ১০টার পর এবং বিকাল পাঁচটার আগে রাস্তায় না বেরোনোই ভালো। কিন্তু এই রুটিন মেনে চলা সম্ভব না হলে সর্তকতা মানতে হবে। বাইরে গেলে ছাতা নিন বা মাথায় কাপড় বেঁধে নেবেন, সানগ্লাস ব্যবহার করবেন। মাস্ক বা সুতির ওড়না দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে নেওয়া ভালো। সঙ্গে পানি রাখবেন। পরতে হবে হালকা সুতির পোশাক। সকাল ১০টার মধ্যে বাড়িতে রান্না বা কাপড় কাচার মতো পরিশ্রমের কাজ সারতে পারলে ভালো। চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বলেন, ‘গরমে প্রচুর ঘাম হয়। ঘামের সঙ্গে শরীর থেকে লবণ বেরিয়ে যায়। ফল ডিহাইড্রেশন। তাই প্রচুর পানি খেতে হবে। পানির পাশাপাশি মাঝেমাঝে ইলেকট্রলাইট ওয়াটার, লবণ-চিনি-লেবুর পানি পান করুন। গ্লুকোজ পানি কিছুটা লবণ মিশিয়ে খান। বাড়িতে থাকলেও এই নিয়ম মেনে চলুন। তবে ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, বা হার্টের সমস্যা যাদের আছে, তারা এই গরমে দিনে কতটা পানি খাবেন সেজন্য চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সময়মতো চিকিৎসা না পেলে হিটস্ট্রোকে মারা যেতে পারেন আক্রান্ত হয়ে। তাই ভয় না পেয়ে সচেতন থাকুন।
কয়েকটি সচেতনতা : দিনে অন্তত দুইবার গোসল করতেই হবে। বিকালে বাচ্চারা খেলে আসার পর ভালো করে গোসল করিয়ে দেবেন। বাইরে বেরোনোর আগে পানি খেয়ে নিন। রোদ থেকে এসে কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে পানি খেতে হবে। প্রস্রাব ঠিক মতো হচ্ছে কি না খেয়াল রাখুন। গরম থেকে এসেই ঠান্ডা পানি খাবেন না। এতে সর্দি-কাশি, গলাব্যথার সম্ভাবনা থাকে। জ্বর এলে সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ খাবেন না। দুয়েকদিনে জ্বর না কমলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। অন্যান্য কোনো উপসর্গ থাকলে চিকিৎসককে বলুন। বাইরে থেকে এসেই এসি ঘরে না ঢুকে একটু বাইরে জিরিয়ে নিন। এসি অফিসে ঢোকার সময়েও আগে ছায়ায় দাঁড়িয়ে জিরিয়ে নিন। গরমে হালকা খাবার খান। মসলাদার খাবারের পরিবর্তে তেতো, আমডাল, মাছের ঝোল, লাউ, টক দই, মৌসুমি ফল খেতে হবে। তবে বাজারের কাটা ফল, লেবু পানি নয়। ডাবের পানি, বাড়িতে তৈরি ফলের রস, লাস্যি, আখের রস, ছাতুর শরবত খান। সুগার কমে যাওয়ার প্রবণতা থাকলে সঙ্গে রাখুন লজেন্স বা মিষ্টি। প্যাকেজড ফুড, রেডি টু ইট খাবার এড়িয়ে চলুন।