২০১৪ সালে আমেরিকায় যেতে ব্যর্থ হন নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার যুবক ওমর ফারুক। এতে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। ফের কুয়েতে যেতে ঋণ করে ৭ লাখ টাকা জমা দেন তিনি। ভাগ্য সহায় হয়নি ওমর ফারুকের। তাতেও ব্যর্থ হন। ৩৩ লাখ টাকার ১ টাকাও ফেরত পাননি। বাবার পতিত জমিতে দুটি দুগ্ধজাত গরু দিয়ে শুরু করেন ভাগ্যবদলের চেষ্টা। সেখান থেকে এখন তার খামারে ২৬টি গরু আছে। ওমর ফারুক কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরপার্বতী ইউনিয়নের মান কাজি ব্যাপারী বাড়ির আবুল হোসেনের ছেলে। তিনি নোয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেছেন। তার খামার চরপার্বতী ইউনিয়নে হলেও দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্যগুলো বিক্রি করছেন চর হাজারী ইউনিয়নের হাজারী হাট সড়কের ফারুক সুইটস অ্যান্ড দধি হাউস নামে দোকানে। খামারের দুধ দিয়ে তৈরি দই, মিষ্টি, রসমালাই, ঘি ও মাখন বিক্রি করে তিনি সাড়া ফেলেছেন। পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসে হয়ে উঠেছেন সফল উদ্যোক্তা। তাকে দেখে অনেকেই গরুর খামার করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তায় বাড়তি দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করে নোয়াখালী জেলায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন তিনি। তার খামারের দুধ থেকে তৈরি দুগ্ধজাত পণ্য কিনতে বিভিন্ন স্থান থেকে আসছে মানুষ। পরিশ্রমই তাকে সফলতা এনে দিয়েছে। সাতজন কর্মচারীর বেতন দিয়ে মাসে আয় হয় লাখ টাকা। ওমর ফারুক বলেন, ২০১৪ সালে আমি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমাদের এলাকায় বেশিরভাগ মানুষ বিদেশগামী। আমিও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য আমেরিকা যেতে চাইলাম। বাবা ঋণ ও সম্পত্তি বিক্রি করে ২৬ লাখ টাকা দিলেন। আমার পুরো টাকাই মার খেলো। স্বপ্নের আমেরিকা যেতে পারলাম না। তারপর কুয়েতে যাওয়ার জন্য সাত লাখ টাকা দিলাম। তাও মার খেলো। যেতে পারলাম না। নিজেকে স্বাবলম্বী করার জন্য এলাকায় একটা মাছের ঘের দিলাম। সেটার মাছ চুরি হয়ে গেল। আমি বিশাল ক্ষতির মুখে পড়লাম। ঋণে জর্জরিত হয়ে গেছি। কেউ আর ঋণ দিচ্ছে না। তারপর ১ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে দুইটা দুধের গরু কিনলাম। ৮ বছর খামারের বয়স। বর্তমানে আমার ২৬টা গরু আছে। যার দাম প্রায় ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকা। উপজেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহায়তায় বাড়তি দুধ থেকে দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করছি। মোট সাতজন কর্মচারী আছে। তাদের বেতন দিয়ে আমার মাসে এক লাখ টাকা আয় হয়। তিনি আরও বলেন, দৈনিক আমার খামারে প্রায় ১৫০ লিটার দুধ হয়। আমি দুধ বিক্রি করতে পারতাম না। সরকারি সহায়তা পেয়ে আমার খামারে দুধ ও পার্শ্ববর্তী খামারিদের দুধ থেকে আমি দুগ্ধজাত পণ্য দই, মিষ্টি, রসমালাই ও ঘি তৈরি করছি। আলহামদুলিল্লাহ এসব পণ্যের মান অনেক ভালো। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আমার দোকান থেকে পণ্য নিতে আসে। তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে এসব পণ্য নিয়ে যায়। আমাদের এখানে প্রচুর দুধ উৎপাদন হয়। কিন্তু খামারিরা ন্যায্যমূল্য পান না। এক সময় আমিও ন্যায্যমূল্য পেতাম না। তাই আমার দোকানের মাধ্যমে খামারিরাও ন্যায্যমূল্য পায় এবং ভোক্তারাও খাঁটি পণ্য পায়। ব্যবসার পরিধি দিন দিন বৃদ্ধি করতে চাই।
ওমর ফারুকের প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম মানিক বলেন, ওমর ফারুক ভালো মানের খামারি। তিনি অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে তিনি সফল হয়েছেন। তার মাধ্যমে ছোট ছোট খামারিরা তাদের দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন। আমি ফারুক ভাইয়ের আরো সফলতা কামনা করছি। ওমর ফারুকের বাবা আবুল হোসেন বলেন, আমার ছেলে শিক্ষিত হয়ে খামার করছে আমি তাতে খুশি। আমার কিছুই ছিল না। সে খামার দিয়ে সফলতা পেয়েছে। এখন ঠিকমতো খেতে পারি। বাড়িতে বিল্ডিং হয়েছে। ব্যবসার প্রসার হচ্ছে। সরকারি সহায়তা পেয়ে সে ভালো করছে। বাবা হিসেবে আমি গর্বিত।
চর হাজারী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এজেডএম মহিউদ্দিন বলেন, আমাদের কোম্পানীগঞ্জের মানুষ বিদেশ যেতে খুবই আগ্রহী। কিন্তু উদ্যোক্তা হতে আগ্রহ কম। দেশে থেকে যে কিছু করা যায়, সেটার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ওমর ফারুক ভাই। তার দোকানের মিষ্টি খুবই উন্নত মানের এবং সুস্বাদু। আমরা যে কোনো অনুষ্ঠানে তার দোকানের মিষ্টি কিনি। আমাদের পরিচিতরাও তার থেকে মিষ্টি, দই ক্রয় করেন। সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যে স্বপ্ন অনাবাদি জমিকে আবাদি করা; সেই স্বপ্ন পূরণে কাজ করছে। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে আট-দশজনকে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আমরা গর্বিত একজন ওমর ফারুককে পেয়ে।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. তাসলিমা ফেরদৌসী বলেন, ওমর ফারুক শিক্ষিত ও পরিশ্রমী যুবক। তার সঙ্গে কথা বলে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সন্তুষ্ট হয়েছে। তার ভেতরে আগ্রহ আছে। আমরা ন্যাশনাল অ্যাগ্রিকালচারাল টেকনোলজি প্রোগ্রাম-২ এর প্রকল্প অনুযায়ী তাকে সহযোগিতা করেছি। ফারুক কোম্পানীগঞ্জে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে দুগ্ধজাত পণ্য বিক্রি করছে। বিশেষ করে দই, মিষ্টি ও ঘি জনপ্রিয়। আমি বলবো লাখ লাখ টাকা দিয়ে বিদেশে না গিয়ে প্রাণিসম্পদে আস্থা রাখলে সফলতা আসবে। ওমর ফারুক এখন সবার কাছে উদাহরণ। তাকে দেখে দিন দিন মানুষ অনুপ্রাণিত হচ্ছে। নোয়াখালী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাচ্ছেন মানুষ যেন কর্মসংস্থানের জন্য প্রাণিসম্পদে আগ্রহী হয়।
কোম্পানীগঞ্জের ফারুক তেমনই একজন। তিনি বিভিন্নভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ডেইরি খামার দিয়ে এবং ডেইরি প্রোডাক্ট করে আজ সফলতা পেয়েছেন। এমন ফারুক নোয়াখালীসহ সারা বাংলাদেশে আছে। আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চল নিঝুম দ্বীপেও মানুষ প্রাণিসম্পদে আগ্রহী হচ্ছে। এভাবে আমরা প্রাণিসম্পদে স্বনির্ভর হবো।