পাহাড়ে বিশেষ অভিযানেও থামছে না অপহরণ বাণিজ্য
* ১ মাসে অস্ত্রসহ আটজন গ্রেপ্তার, আদালতে ছয়জনের জবানবন্দি * অপহৃত তিনজনকে উদ্ধার করল এলাকাবাসী
প্রকাশ : ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
অপহরণ, মুক্তিপণ বাণিজ্য ঠেকাতে পাহাড়ে ঘিরে পুলিশি বিশেষ অভিযানেও থামছে না অপহরণ বাণিজ্য। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মোছনী এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় এই তিনজনকে। পরে ভোর থেকে পুরো পাহাড় ঘিরে শত শত এলাকাবাসী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। গতকাল সকাল ১০টার দিকে পাহাড় থেকে তাদের উদ্ধার করে গ্রামবাসী। অন্যদিকে অপহরণ বাণিজ্য ঠেকাতে পুলিশের বিশেষ অভিযানও অব্যাহত রয়েছে। তার আলোকে গত বুধবার দিবাগত রাতে অস্ত্রসহ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গেল এপ্রিল মাসে অস্ত্র, গোলা-বারুদসহ ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এরই মধ্যে ৬ জন অপহরণকারী পৃথকভাবে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে টেকনাফ মডেল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গনি বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অপহরণ ঠেকাতে এই অভিযান চলমান থাকবে বলে জানান তিনি।
ভুক্তভোগীদের মতে, গত ৩ বছরে দেড় শতাধিক মানুষ অপহরণকারীদের কবলে পড়েছে। তাদের মাঝে ছিল স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাপড়ুয়া, কাঠুরিয়া, জেলে, কৃষক, প্রবাসী ও পল্লি চিকিৎসক। এমনকি অপহরণের পর দাবিকৃত মুক্তিপণ দিতে না পেরে খুনের শিকার হয়েছেন ৫ জন। দিনের পর দিন অপহরণ বাণিজ্য বেড়ে চলায় এ অঞ্চলের মানুষ অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সিন্ডিকেট মিলে অপহরণ বাণিজ্য করে আসছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় অসাধু কিছু জনপ্রতিনিধি।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী ও স্থানীয় ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের মোছনী এলাকা থেকে অপহরণ করা হয় এই তিনজনকে। পরে ভোর থেকে পুরো পাহাড় ঘিরে শত শত এলাকাবাসি সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। সকাল ১০টার দিকে পাহাড় থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। অপহৃতরা হলেন, হ্নীলা ইউনিয়নের মোছনী গ্রামের আশরাফ জামানের ছেলে নীর আহমেদ ও হাবিবুর রহমান, হাবিবুর রহমানের তার ছেলে নুর ফয়েজ।
ইউপি সদস্য মোহাম্মদ আলী জানান, প্রতিদিনের মতো হ্নীলা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মোছনী গ্রামের বাসিন্দা নীর আহমেদ, হাবিবুর রহমান ও তার শিশু ছেলে নুর ফয়েজ মোছনী নিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পশ্চিম পাহাড়ের পাদদেশে ধান ক্ষেত পাহারা দিচ্ছিলেন। এ সময় ভোর রাত ৩টার দিকে একদল দুর্বৃত্ত এসে তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে অপহরণ করে। অপহরণের খবর পেয়ে বিক্ষুব্ধ শত শত এলাকাবাসী পুরো পাহাড় ঘিরে লাঠি হাতে অভিযান শুরু করে। খবর পেয়ে পুলিশও ঘটনাস্থলে আসার এক পর্যায়ে অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা কৌশলে পালিয়ে যায়। সকাল ১০টার দিকে ৩ জনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী জানান, একের পর এক অপহরণের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী এখন সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করতে শুরু করেছে। এর জের ধরেই পাহাড়ে এলাকাবাসীর এই অভিযান। দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনজনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তিনি এলাকাবাসীকে অপহরণসহ সকল অপরাধ রোধে সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ অব্যাহত রাখার আহ্বানও জানান।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ নুর আহমেদ আনোয়ারী বলেন, গত কয়েক বছরে এ অঞ্চলের বিভিন্ন পেশার দেড় শতাধিক মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে। তারা প্রত্যেকে মুক্তিপণের মাধ্যমে ছাড়া পেয়েছেন। দিনের পর দিন যেভাবে অপহরণের ঘটনার বাড়ছে, এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীরা বাড়ি ফিরতেও ভয় পায়। একদিকে অপহরণ আতঙ্ক, অপরদিকে তাদের জীবিকা- উভয় সংকটে কষ্টে দিনযাপন করছেন সাধারণ মানুষ।
মামলা তদন্তকারী কর্মকর্তা ও বাহাড়ছড়া পুলিশ ফাঁড়ির উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. দস্তগীর হোসেন বলেন, অপহরণ রোধের পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান চলমান রয়েছে। তার ধারাবাহিকতায় গত বুধবার রাতে অস্ত্রসহ সিরাজকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি বলেন, গেল এপ্রিল মাসে অপহরণে জড়িত ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার মধ্যে ৬ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্যদের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, গত বুধবার রাতে গ্রেপ্তারকৃত সিরাজ পৃথক তিনটি মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আগের দুইটি অপহরণ মামলা রয়েছে। নতুন করে অস্ত্র আইনে আরেকটি মামলা রুজু করা হয়েছে বলে জানান এই কর্মকর্তা।
টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ ওসমান গণি জানান, অপহরণের বিষয়টি জেনে এলাকাবাসী পুলিশের আগের পাহাড় ঘিরে রাখে। এর মধ্যে পুলিশও ঘটনাস্থলে পৌঁছে। এক পর্যায়ে তিনজনকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ধার তিন ব্যক্তি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।
প্রসঙ্গত : ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের ২ মে পর্যন্ত টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১২৪ জনকে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬৬ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকিরা রোহিঙ্গা নাগরিক। অপহরণের পরিবারের তথ্য বলছে অপহরণের শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত ৫৩ জন মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছে।